বিশ্বকাপের আসল ম্যাচের ফুটেজ আছে এ ছবিতে
কবির খান পরিচালিত ‘এইটিথ্রি’ ছবিটি ১৯৮৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের ঐতিহাসিক জয়কে কেন্দ্র করে। ইংল্যান্ডের লর্ডসের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ জয় করেছিল ভারত। তবে এই জয়ের পেছনে অনেক লাঞ্ছনা, অবহেলা, শ্রম, ত্যাগ লুকিয়ে ছিল।
‘৩৫ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু সম্মান অর্জন করা এখনো বাকি আছে, ক্যাপ্টেন’—ভারতীয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজার পি আর মান সিং (পঙ্কজ ত্রিপাঠী) অধিনায়ক কপিল দেবের (রণবীর সিং) উদ্দেশে এই সংলাপটি বলেছিলেন। আর ‘এইটিথ্রি’ ছবির এই সংলাপের মধ্যে স্পষ্ট যে এটা শুধু ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের খেলা ছিল না, এটা ছিল সম্মান অর্জনের খেলা।
পরিচালক: কবির খান। অভিনয়ে: রণবীর সিং, দীপিকা পাড়ুকোন, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, বোমান ইরানি, সাকিব সালিম, সাহিল চাড্ডা, নীনা গুপ্তা প্রমুখ।
কবির খান পরিচালিত ‘এইটিথ্রি’ ছবিটি ১৯৮৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের ঐতিহাসিক জয়কে কেন্দ্র করে। ইংল্যান্ডের লর্ডসের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ জয় করেছিল ভারত। তবে এই জয়ের পেছনে অনেক লাঞ্ছনা, অবহেলা, শ্রম, ত্যাগ লুকিয়ে ছিল। এই গৌরবময় জয়ের পেছনের অনেক অকথিত কাহিনি পর্দায় সুন্দর করে তুলে ধরেছেন পরিচালক। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ‘এইটিথ্রি’ ছবির ক্লাইমেক্স সবার জানা। তবু দর্শক আসনে উপস্থিত সাংবাদিকেরা প্রতিটি দৃশ্যে বারবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলেন। ৩৮ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক জয়কে হাসি, কান্না, আবেগ, করতালি দিয়ে আবার স্বাগত জানান তাঁরা।
পরিচালক কবির খানের অসাধারণ পরিচালনায় রুপালি পর্দায় বাস্তব হয়ে উঠেছিল লর্ডসের মাঠে সেই অবিস্মরণীয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়।
শুরু থেকেই ভারতীয় ক্রিকেট দলের ওপর কারও আস্থা ছিল না। একদমই ‘আন্ডার ডগ’ হয়ে মাঠে নেমেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। তাই ফাইনাল ম্যাচের আগেই ভারতীয় দলের ভারতে ফেরার টিকিট কাটা ছিল। তবে শুধু একটা মানুষই শুরু থেকে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে মশগুল ছিলেন, তিনি হলেন অধিনায়ক কপিল দেব। তিনি যেন জানতেন, এই জয় নিশ্চিত।
‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন রবে’—এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন কপিল দেব। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই), সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল না এই দলের ওপর। প্রতিটি মুহূর্তে নিচু করে দেখানো হতো তাদের। ছবির শুরুতে পরিচালক পাসপোর্টের মাধ্যমে সমগ্র ক্রিকেট দলের সঙ্গে পরিচয় করান। এই দৃশ্যতেই ধরা পড়ে পরিচালকের মুনশিয়ানা। আজ ক্রিকেটের সঙ্গে প্রচুর অর্থ, নাম, যশ, প্রতিপত্তি, গ্ল্যামার—সবকিছু জড়িয়ে আছে। কিন্তু ওই সময় ক্রিকেটাররা আর্থিক কষ্টে ভুগতেন। ভারত থেকে ইংল্যান্ডে ভারতীয় ক্রিকেটারদের ক্রিকেটের সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার জন্য ম্যানেজার মান সিংকে রীতিমতো টাকা ধার করতে হয়েছিল। এমনকি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ময়দানে খেলার মতো ভালো জুতা পর্যন্ত ছিল না ক্রিকেটারদের কাছে। হোটেলের একটি ঘর ভাগ করে নিতে হয়েছিল একাধিক ক্রিকেটারকে সঙ্গে। তখন ক্রিকেটাররা এতটাই কম বেতন পেতেন যে সম্পন্ন ঘরের মেয়েদের তাঁদের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইত না।
তাই এই অসাধারণ জয়ের পেছনে আছে অজস্র অসাধারণ ছোট ছোট সংঘর্ষ, যা কবির খান নানাভাবে পর্দায় মেলে ধরেছেন। ক্রিকেট যে জাতপাত, ধর্মের ঊর্ধ্বে, তা ‘এইটিথ্রি’ ছবিতে সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। আর তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করতে সেই সময়ের সরকার ‘ক্রিকেট’–এর সাহায্য নিয়েছিল।
‘এইটিথ্রি’ ছবির গল্প খুব সুন্দরভাবে গাঁথা হয়েছে। ছবির মাঝে মাঝে পরিচালক খুব সুন্দরভাবে আসল ম্যাচের ফুটেজগুলো যুক্ত করেছিলেন। এই জয়ের অন্যতম নায়ক কপিল দেব হলেও সব ক্রিকেটারকে প্রায় সমানভাবে দেখানো হয়েছে। কপিল দেবের বিশ্ব রেকর্ড, মহিন্দার অমরনাথের ব্যাটে-বলে কামাল থেকে রজার বিনির ম্যাজিক্যাল স্পেল, কিরমানির দুর্ধর্ষ কিপিং—সবকিছু ছবিতে ধরা পড়েছে। ’৮৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ময়দানে ভারতের অজস্র স্মরণীয় মুহূর্ত পরিচালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরেছেন।
কবির খানের পরিচালনার পাশাপাশি এই ছবির প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী নিজেদের শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন। প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী মহিন্দার অমরনাথ, রজার বিনি, সুনীল গাভাস্কার, শ্রীকান্ত, মদন লাল, বলবিন্দর সান্ধুসহ সব ক্রিকেটারকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তাই কাস্টিং পরিচালকের আলাদা করে প্রশংসা প্রাপ্য।
তবে ‘এইটিথ্রি’ ছবিতে আলাদা করে নজর কেড়েছেন কপিল দেবের ভূমিকায় রণবীর সিং। তরুণ কপিলকে আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন রণবীর।
তিনি শুধু ব্যাটে–বলে বা লুকে কপিল হয়ে ওঠেননি, কপিল দেবের মতো আদবকায়দা, শারীরিক ভাষা, ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলা থেকে সবকিছু রপ্ত করেছেন রণবীর। তাঁর স্ত্রী রোমির চরিত্রে দীপিকা পাড়ুকোনের স্বল্প উপস্থিতি ছবিতে ছাপ ফেলেছে। ম্যানেজার মান সিংয়ের চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠী অত্যন্ত সাবলীল। ক্রিকেটার ফারুক ইঞ্জিনিয়ার আর ধারাভাষ্যকারের চরিত্রে বোমান ইরানিকে দেখা গেছে। তিনি প্রাণবন্ত অভিনয়ের মাধ্যমে ছবিটিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। এমনকি ‘এইটিথ্রি’ ছবিতে বিদেশি ক্রিকেটারের চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরাও যথাযোগ্য।
‘এইটিথ্রি’ ছবিতে প্রীতমের সংগীত এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। এই ছবির গানগুলোতে দেশাত্মবোধ, আবেগ ভরপুর। নীতীন বৈদ্যের দক্ষ সম্পাদনা ছবিটিকে আরও উচ্চস্তরে পৌঁছে দিয়েছে। অসীম মিশ্রর সিনেমাটোগ্রাফি প্রশংসনীয়। ছবির শেষে স্বয়ং কপিল দেব আর ম্যানেজার মান সিং ‘এইটিথ্রি’ বিশ্বকাপের সেই রোমাঞ্চকর জয়ের অনুভূতি তুলে ধরেছেন—এই ছবি থেকে যা উপরি পাওনা। তাই ৩৮ বছর আগে সেই ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হয়ে ওঠার জন্য সপরিবার ‘এইটিথ্রি’ দেখা জরুরি।