নির্মাতা বাবাকে নির্মাতা ছেলের খোলাচিঠি

বাবাকে নিয়ে সোহেল আরমানের আবেগঘন পোস্ট

চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেনের আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বাবাকে স্মরণ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখেছেন তাঁর ছোট ছেলে সোহেল আরমান। বাবার অবর্তমানে মাকে নিয়ে নিঃসঙ্গ সংসার, সর্বত্র বাবার নেপথ্য উপস্থিতি আর স্মৃতিচারণামূলক সেই পোস্ট অনেককে স্পর্শ করেছে। ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমজাদ হোসেন থাইল্যান্ডের ব্যাংককে মারা যান।

নির্মাতা সোহেল আরমান লিখেছেন, ‘বাবা, দেখতে দেখতে তিনটি বছর পার হয়ে গেল। তোমাকে ছাড়াই আছি এই পৃথিবীতে। কেমন আছ তুমি? জানো, তোমার ফেলে যাওয়া জিনিসগুলো এখনো তোমার ঘরে সাজিয়ে রেখেছে মা। কাউকেই স্পর্শ করতে দেয় না, এমনকি আমাকেও না। তোমার ওই ফেলে যাওয়া ছোট ছোট জিনিসের প্রতিদিনই খেয়াল রাখছে মা। ওটাই এখন মায়ের সান্ত্বনা, বেঁচে থাকা।’

স্ত্রী সুরাইয়া আকতারের সঙ্গে আমজাদ হোসেন
ছবি : পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

বাবার কাছে লিখতে গিয়ে যেন কল্পনার জগতে প্রবেশ করেন সোহেল আরমান। তিনি লেখেন, ‘মায়ের এক অযৌক্তিক বিশ্বাস, হঠাৎ তোমার ডাক শোনা যাবে...“এই আলো, (বাবার দেওয়া মায়ের ডাকনাম) আমার শার্টটা আয়রন করা হলো? ঘড়িটা কোথায় দেখো তো? ড্রাইভারকে বলো, আমি বের হব, মিটিং আছে।” মা বলবে, “নাশতা করে যাও।” তুমি বলবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নেওয়া। যাওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে নিয়মমাফিক জেনে নেওয়া, সংসারে কী কী লাগবে। দিন শেষে আবার তোমার ফিরে আসা-আমাদের উদ্গ্রীব মুখ, সঙ্গে করে কী আনল বাবা আমাদের জন্য? কলিং বেলের আওয়াজটাই সবার চেয়ে একটু ভিন্ন ছিল তোমার, আমরা বুঝতাম, বাবা এসেছে। কখনো কখনো গাড়ির হর্ন শুনেও বুঝতাম, তুমি বাড়ি ফিরেছ।’

বাবার চলে যাওয়া নিয়ে এক অভিমানের কথাও উঠে আসে সোহেলের পোস্টে। তিনি লেখেন, ‘২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর ভোরবেলা তুমি অসুস্থ হয়ে সেই যে হাসপাতালে গেলে, আর তো বাড়ি ফিরলে না। তারপর ২৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেলে, আজ সেই ১৪ ডিসেম্বর। এই তারিখের প্রতি অনেক অভিমান আমার। এই তারিখে তোমার জন্ম (১৯৪২) আবার এই তারিখেই তুমি চলে গেছ ওপারে (১৪ ডিসেম্বর ২০১৮। এভাবেই তোমার কত শত স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি আমরা। বাবা, তুমি এতটাই বড় তোমার অস্তিত্বে, এতটাই বড় আকাশের মতো, তোমার অনুভব আজও আমাকে বোধ দেয়, তুমি আছ সর্বক্ষণ আমারই চারপাশে।’

বাবা আমজাদ হোসেনের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন দুই ছেলে সোহেল আরমান ও সাজ্জাদ হোসেন দোদুল
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রয়াণের দিনে বাবার প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে সোহেল লিখেছেন, ‘তোমাকে ভালোবাসি বাবা, প্রত্যেক সন্তানের মতোই। তবে বাবা যে আসলেই সন্তানের জন্য কত বড় একটা বটবৃক্ষ, কত উত্তপ্ত দিনে কী নিবিড় পরম শান্তির ছায়া দেয়! প্রচণ্ড ঝড়ে কী করে যে আগলে রাখে, তার উদাহরণ তুমিই এবং তোমার মতো আদর্শ সব বাবা। আজ বাবার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সবাই বাবার আত্মার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশত নসিব করেন।’

মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারের আয়োজনে ‘আয়নাবাজি’ ছবির পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরীর হাতে সেরা পরিচালকের পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন নির্মাতা আমজাদ হোসেন ও নৃত্যগুরু লায়লা হাসান
ফাইল ছবি

প্রয়াণের এই দিনে আজ নির্মাতা প্রয়াত আমজাদ হোসেনকে স্মরণ করে তাঁর মাতৃভূমি জামালপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের ৭০টি সংগঠন। জামালপুর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আমজাদ হোসেনের কর্মময় জীবন তুলে ধরা হবে আলোচনায়। ৭০টি সংগঠনকে নিয়ে এ আয়োজনটি করছে আমজাদ হোসেন চর্চা কেন্দ্র। এ ছাড়া এফডিসিতেও আমজাদ হোসেন স্মরণে শ্রদ্ধা ও দোয়ার আয়োজন করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচালকেরা।

আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন দোদুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের চলচ্চিত্রকে নতুন আঙ্গিকে যে কজন তুলে ধরেছিলেন, বাবা তাদের অন্যতম। সারা জীবন তিনি চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করে গেছেন। বাবা মারা যাওয়ার জামালপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তাঁর স্মরণে প্রতি বছর নানা আয়োজন করেছিল। এবারও জামালপুর শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী, খেলাঘরসহ ৭০টি সংগঠনের অংশগ্রহণে সকালে ছিল আলোচনা ও দোয়া। পরে শোক র‍্যালি। মসজিদেও দোয়ার ব্যবস্থা ছিল।’

অভিনেতা, পরিচালক, গীতিকার আমজাদ হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

আমজাদ হোসেন ১৯৬১ সালে ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনে আসেন। পরে চিত্রনাট্য রচনা ও নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৭ সালে আমজাদ হোসেন ‘আগুন নিয়ে খেলা’ নামে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। পরে তিনি ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ভাত দে’র মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ও ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া শিল্পকলায় অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারও পেয়েছেন। আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির আজীবন সদস্য।