বাংলায় পিরিয়ড সিনেমা বানানো কী সম্ভব

ইতিহাসনির্ভর ছবি করতে দরকার যথাযথ গবেষণা ও অনুসন্ধান

একাত্তরে ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা নিয়ে নির্মিত হবে আগুনের পরশমণি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ চাইলেন একটা কামান। মুক্তিযুদ্ধকে পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে এভাবে নানা জায়গা থেকে নানা উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। এভাবে সীমিত বাজেটের মধ্যেও দূর অতীতকে সিনেমার পর্দায় জীবন্ত করে তুলতে একসময় মোটামুটি সিদ্ধহস্ত ছিলেন ঢাকার পরিচালকেরা। এ কাজে যতটা আত্মনিবেদন প্রয়োজন, সেটা এখন অনেক কমে গেছে। আর এর নেপথ্যে জমা হয়েছে নানামাত্রিক ক্ষয়।

দূর ও নিকট অতীতের ঘটনা নিয়ে ঢাকায় বেশ কিছু সিনেমা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে খান আতাউর রহমান বানিয়েছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা, ইবনে মিজান ১৯৬৮ সালে বানান শহীদ তিতুমীর, সৈয়দ হাসান ইমাম ১৯৭৩ সালে বানান লালন ফকির, মশিহউদ্দীন শাকের-শেখ নিয়ামত আলী ১৯৭৯ সালে সূর্য দীঘল বাড়ি। এখনো সেই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি মুক্তির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এন রাশেদ চৌধুরীর ছবি চন্দ্রাবতী কথা, শুটিং চলছে কাজী হায়াতের জয় বাংলা, রাশিদ পলাশের প্রীতিলতা এবং ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার ছবি বঙ্গবন্ধু।

চন্দ্রাবতী কথা ছবির দৃশ্য

সিনেমায় দূর অতীতকে তুলে ধরার সংকট ও ঘাটতিগুলো আসলে কোথায়। এই সময়ে এসে ষোড়শ শতকের কবি চন্দ্রাবতী, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী প্রীতিলতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গল্প বলা কতটা চ্যালেঞ্জের? এন রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাজেট। অতীতের পরিবেশে ফিরে যেতে, সময়টাকে পুনরায় তৈরি করতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে হয়। তা ছাড়া ইতিহাসনির্ভর ছবি করতে দরকার যথাযথ গবেষণা ও অনুসন্ধান। সময়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরতে বাড়িঘরের ভেতরে–বাইরে অতীতের আবহ ফুটিয়ে তুলতে হয়। এ কাজের ব্যয় অনেক। আমাদের দেশের চেহারা দ্রুত বদলে গেছে। ’৭১ সালের আগেও এত টিনের বাড়ি ছিল না, যতটা পরে তৈরি হয়েছে।’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, এ ধরনের কাজে প্রযোজক–সংকট সব সময়ই থাকে। সরকারের কাছ থেকে মাত্র ৩৫ লাখ টাকা অনুদান পেলেও অনেকগুলো টাকা তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়েছে।

প্রীতিলতা ছবির চিত্রনাট্যকার গোলাম রাব্বানী জানালেন, ছবিতে প্রীতিলতার সময়ের অনেক কিছুই তুলে ধরা হবে, যার বেশির ভাগেরই সেট নির্মাণ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া তখনকার বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। জোগাড় করতে হয়েছে বহু বই, শরণাপন্ন হতে হয়েছে গবেষকদের। রাব্বানী বলেন, ‘প্রীতিলতা যে স্কুলে পড়েছিলেন, খাস্তগীর স্কুল; তাঁর ওপর যেখানে হামলার দায়িত্ব পড়েছিল, ইউরোপিয়ান ক্লাব—এসব জায়গায় আমরা শুটিং করতে পারব। যে অপর্ণাচরণ স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন, সেটার সেট আমাদের বানাতে হবে। এ ধরনের ছবি বানানোর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমরা যেমন স্থাপনা ধ্বংস করি, ইতিহাসও সংরক্ষণ করি না। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বইপত্র অপ্রতুল।’ এ ছাড়া প্রীতিলতার চারপাশের মানুষ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, পোশাকের অনুসন্ধান করতে হয়েছে। এ কাজে চট্টগ্রামের অনেকের সহযোগিতা পেয়েছেন তাঁরা।

‘আলোর মিছিল’ ছবির পোস্টার

ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র। কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে কীভাবে সেসব ছবি বানানো সম্ভব? চলচ্চিত্র গবেষক মতিন রহমান বলেন, ‘গল্প আছে, সম্ভাবনা আছে। তবে এটা বিশাল গবেষণা, সময় ও বাজেটের ব্যাপার। এ ধরনের কাজের মানসিকতা, শ্রম দেওয়ার মতো পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীও দরকার। কিন্তু নির্মাতা, লগ্নিকারকের উৎসাহ কম। দেশ, সংস্কৃতি, নেতা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এ রকম ছবি বানানো যায়।’

সাংস্কৃতিকভাবে সংরক্ষণের প্রবণতা ও জ্ঞানের অভাবকেও একটি সমস্যা মনে করেন তিনি। মতিন রহমান বলেন, ‘এ কে ফজলুল হক বা ফকির মজনু শাহকে নিয়ে ছবি বানানোর শক্তি বা মানসিকতা আছে কার? আমাদের আসলে এ ধরনের ছবি বানানোর প্রস্তুতি, মেধা, চর্চা, ভালোবাসা নেই। ভালোবাসা ছিল বলে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাজেটের অতিরিক্ত খরচ করে পুরো ট্রেন ভাড়া করে রং করে ফেলেছিলেন। মোরশেদুল ইসলাম বাস–ট্রেন সব রং করেছিলেন। এটা ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ। ঈসা খাঁর ছবি, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলোর যোদ্ধাদের স্মৃতিচিহ্ন, ছবি সংগ্রহে আছে? না থাকলে হিস্টরিক্যাল রিয়্যালিটি আনা যাবে? আমাদের রিসার্চ ম্যাটেরিয়াল লাগবে। ভাষা আন্দোলনের ফুটেজ ও ছবি কিনতে ব্রিটিশ বা দিল্লির লাইব্রেরিতে যাওয়ার অনুমতি আর টাকা কে দেবে? জাতি হিসেবে আমাদের মানসিকতা, অর্থ, আয়োজনের ঘাটতি আছে।’