ভোটার বাড়াতে নতুন কৌশল

২০১৯ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচনছবি: সংগৃহীত

গত দেড় মাসে প্রায় ৫০টি ছবিকে সেন্সর সনদ দিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। এমনকি শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনেও সিনেমার প্রিভিউ হয়েছে। দিনে যেখানে একটি বা দুটি ছবিকে সেন্সর সনদ দেওয়া হয়, এই সময়ে দেওয়া হয়েছে দিনে পাঁচ থেকে ছয়টি ছবির। এমনকি শুক্রবারও সেন্সর বোর্ড থেকে সনদ সংগ্রহ করেছেন প্রযোজকেরা। বিশেষ কারণ ছাড়া তাড়াহুড়ো করে একসঙ্গে এত ছবির প্রিভিউ ও সেন্সর সনদ দেওয়া হয় না। কেন এ তড়িঘড়ি? চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, ২১ মে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচন ঘিরে নিজেদের পক্ষে নতুন ভোটার বাড়াতে ছবি সেন্সর করানোর হিড়িক পড়েছে। এগুলো করছে শাপলা মিডিয়াসহ কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। আর এই চাপে তৈরি হচ্ছে বেশ কিছু নিম্নমানের ছবি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে, মানসম্মত সিনেমা নয়, যেনতেনভাবে সিনেমা বানিয়ে ভোটার বাড়িয়ে সমিতির নেতা হওয়াই মূল লক্ষ্য। এরই মধ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিলে নতুন ভোটার হালনাগাদ করার শেষ সময় ছিল ২১ মার্চ। ২৪ মার্চ প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

তড়িঘড়ি করে সেন্সরের বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সচিব মমিনুল হক জানান, বোর্ডের সদস্যদের সিদ্ধান্তেই এটি করা হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে অতীতে এক দিন সর্বোচ্চ ছয়টি ছবির সেন্সর হয়নি, যেটি এবার হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজ (২১ মার্চ) কলঙ্ক, বউপাগল ও হলি গানসহ পাঁচটি ছবি দেখেছি, তিনটিই শাপলা মিডিয়ার।’

তবে এতগুলো ছবি একসঙ্গে প্রিভিউ ও সেন্সর সনদ দেওয়ার বিশেষ কারণ আছে বলেও জানান সেন্সর বোর্ডের সচিব। তিনি বলেন, ‘প্রযোজক সমিতির নির্বাচনের তফসিলে ২১ মার্চ ছিল ভোটার হালনাগাদ করার শেষ সময়। এই সময়ের মধ্যে সেন্সর সনদও প্রযোজকদের দরকার ছিল। তা ছাড়া অনেক ছবি জমা পড়ার কারণে সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা টানা প্রিভিউ করতে চেয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিন এখানে প্রিভিউ করতে আসতে পারবেন না। এ কারণেই অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কটি ছবির প্রিভিউ করতে হয়েছে।’

কিন্তু চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট অনেকেই এসব ছবির মান কেমন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ব্যাপারে মমিনুল হক বলেন, ‘মান সেন্সর বোর্ড নির্ধারণ করে না। ছবির মধ্যে অশ্লীলতা, রাষ্ট্রবিরোধী কিছু, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কিংবা অন্য দেশবিরোধী সংলাপ আছে কি না, এগুলো দেখে সেন্সর বোর্ড। মান দর্শক নির্ধারণ করবেন।’
নির্বাচনে শাপলা মিডিয়ার কর্ণধার সেলিম খান এবং অমি বনি কথাচিত্রের কর্ণধার ডিপজল মিলে একটি প্যানেল করছেন। নির্বাচন ঘিরেই প্রায় এক বছর আগে থেকে তৎপর সেলিম খান। তিনি জানিয়েছেন, নতুন ভোটার তালিকায় তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ৫৩ জন ভোটার আছেন। জানা গেছে, তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যসহ নামে–বেনামে ভোটার তৈরি করেছেন এই প্রযোজক।

চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, শুধু নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে প্রায় ২৫টির মতো নিম্নমানের ছবিতে বিভিন্ন মানুষের নাম প্রযোজক হিসেবে যুক্ত করে ছবিগুলো সেন্সরে পাস করিয়ে ভোটার বাড়িয়েছে শাপলা মিডিয়া। শুধু তা–ই নয়, ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্ম বানিয়ে পরে সেগুলো সিনেমা হিসেবে সেন্সর সনদ নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ২০ দিনে শাপলা মিডিয়ার ছবি বুবুজান, এবার তোরা মানুষ হ, লটারি, স্বপ্নের রাজকন্যা, জ্বলছি আমি, আপন পর, প্রেমের কবিতা, চাঁদনি, বউপাগল, ২৪.৩–এর রাতসহ প্রায় ২০টির মতো ছবি সেন্সর সনদ পেয়েছে।

গত মাসে মাফিয়া নামে ১০৪ পর্বের ওয়েব সিরিজ থেকে মাফিয়া ১, মাফিয়া ২, মাফিয়া ৩—এমন আটটি সিনেমা বানানো হয়েছে। এবার তোরা মানুষ হ ওয়েব ফিল্মটিও ভোট বাড়ানোর জন্য পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা হিসেবে সেন্সরে পাস করানো হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতে মাফিয়া ১ মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহে মুখ থুবড়ে পড়ে। এই ছবিগুলোর বাজেট ২০ থেকে ৪০ লাখের মধ্যে। এসব নিম্নমানের ছবি প্রভাব ফেলবে পুরো ইন্ডাস্ট্রির ওপর। পরিচালক ও প্রযোজক ইস্পাহানি আরিফ জাহান বলেন, ‘প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কটি ছবিকে সেন্সর সনদ দেওয়া হয়েছে। এখন এমন কিছু সিনেমা তৈরি হচ্ছে, যেগুলোকে সিনেমা বলা চলে না। পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার একটা ভাষা আছে। সিনেমার নামে এসব মানহীন কনটেন্ট চলচ্চিত্রের “অশ্লীল” যুগের চেয়েও খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে। কারণ, এসব ছবি মুক্তির পরে হলে গিয়ে প্রতারিত হবেন দর্শক। সেই প্রভাব পড়বে ভালো ছবির ওপর।’

‘মাফিয়া’ ছবির একটি দৃশ্যে আনিসুর রহমান মিলন ও জাহিদ হাসান

এসব অভিযোগের বিষয়ে সেলিম খান বলেন, ‘কে কী বললেন, তা আমার দেখার দরকার নেই। সেন্সর বোর্ড ছবিগুলো দেখে, বিচার–বিশ্লেষণ করেই সেন্সর সনদ দিয়েছে। আমরা মানহীন ছবি নির্মাণ করি না। তা ছাড়া ছবিগুলো মুক্তির পর হলে বসে মান নির্ধারণ করবেন দর্শক।’ মাফিয়া ওয়েব সিরিজটিকে আটটি সিনেমা এবং এবার তোরা মানুষ হ ওয়েব ফিল্মকে সিনেমা হিসেবে সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমরা এগুলোকে ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ফিল্ম হিসেবেই নির্মাণ করেছিলাম। পরে দেখলাম, যেহেতু ভালো ভালো শিল্পী আছে, কাজও ভালো হয়েছে। তাই এগুলো সিনেমা হতেই পারে।’

ভোটার বাড়াতে নিম্নমানের ছবি তৈরি প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক কাজী হায়াৎ বলেন, ‘এই যে নিম্নমানের ছবি বানিয়ে ভোটার বাড়িয়ে সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হবেন। কিন্তু এই পদে থেকে ইন্ডাস্ট্রির জন্য কী করবেন তাঁরা? ভালো কাজ করলেও হতো। কিন্তু তা তো হবে না। আমি মনে করছি, ইন্ডাস্ট্রির সর্বনাশ করে দিয়ে ভোটে জেতার পাঁয়তারা এটি।’