কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হলো বাংলাদেশের মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সাদ পরিচালিত রেহানা মরিয়ম নূর (যদিও চলচ্চিত্রটির কোনো বাংলা পোস্টার কোনো মাধ্যমে এখনো দেখার সুযোগ পাইনি, তাই কান উৎসবে প্রদর্শিত ইংরেজি পোস্টার থেকে বাংলা নামের বানানটি অনুমান করে নিচ্ছি। বাংলায় চলচ্চিত্রটির নামকরণ করা হবে কি না, সেটিও আমার কাছে আপাতত অজানা)। তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে প্রদর্শনোত্তর সমালোচনা, যা কিছু আমার চোখে পড়েছে, তা বেশ ইতিবাচক এবং প্রশংসামূলক।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির একটি দৃশ্য

যেহেতু তাঁর দ্বিতীয় এই চলচ্চিত্র দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে, তাই কেবল ওই চলচ্চিত্রের প্রচারাংশ (ট্রেলার), ইতিমধ্যে প্রকাশিত প্রশংসামূলক সমালোচনা, কান উৎসবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত চৈনিক চলচ্চিত্র সমালোচকের নেওয়া সাক্ষাৎকার এবং তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ দেখার সূত্রে নিচে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।

১. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের (যার শুরু প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে) পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, সাদের আবির্ভাব চলচ্চিত্রভাষার পরিণত বোধ এবং তার প্রায়োগিক দক্ষতা নিয়ে।

২. অন্য কারোর রচনার ওপর নির্ভর না করে নিজেরই চিন্তা-ভাবনাকে চিত্রনাট্যে রূপায়ণের মাধ্যমে অতর ধারায় পথচলার শুরু।

৩. গল্প বা কাহিনি বলে যাওয়ার বাঁধা গৎ ছেড়ে সমাজের বিরাজমান বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির ঘাত-প্রতিঘাতে সৃষ্ট যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তির অন্তর্জগৎ ও বাহ্যিক আচরণে ধরা দেয়, তারই দিকে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিশেষ দুর্বলতা যে ভাবালুতা, তাকে সর্বাংশে পরিহার করা।

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ছবি: এএফপি

৪. বিষয়বস্তুর নিরিখে আঙ্গিক, চিত্রভাষের ধরন এবং শৈলী বেছে নেওয়ার দক্ষতা। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র উদাহরণ দিচ্ছি। যদিও এই চলচ্চিত্র নিয়ে এখনো কোনো তন্নিষ্ঠ বিশ্লেষণমূলক সমালোচনা বাংলাদেশে হয়নি। তথাপি ‘এশিয়ান টাইমসে’ প্রকাশিত এক বিদেশি চলচ্চিত্র সমালোচকের আলোচনা এবং নিজে একবার দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, বিষয়বস্তু ও প্রকাশ-প্রকরণের সামঞ্জস্য বিধানে সাদ শুরুতেই দক্ষতার শিখর প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছেন। সাদা-কালোর একরঙা বিবর্ণ অনুজ্জ্বল রুদ্ধাতঙ্কের (ক্লাস্ট্রোফোবিক) পরিবেশে প্রধান চরিত্র শেয়ারবাজারের ব্যবসায়ী সাজ্জাদের ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে সাদ প্রকারান্তরে বাংলাদেশের লুটেরা পুঁজিবাদের বিকাশ আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ী অতল গভীর খাদে একচিলতে সুস্থতা ও ভালোবাসাপিয়াসী রেহানার দিশেহারা অবস্থাকেই যেন ঢাকা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছেন। লক্ষণীয়, সাদ প্রথম ছবির শিরোনাম দিয়েছেন ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ যা কিনা সংবাদমাধ্যমের ভাষা। নিজের কোনো মতামত আরোপ না করে বিরাজমান বাস্তবতাকে দর্শক-পাঠকের কাছে সরাসরি সম্প্রচারকেই ‘লাইভ’ আখ্যা দেওয়া হয়। এমন শিরোনাম বেছে নেওয়ার মাধ্যমে সাদের অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা সহজে অনুমেয়। পরপর দুটো চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু থেকে সাদের সপুঙ্খ সমাজবীক্ষণের তীব্রতা এবং সমসাময়িকতার আকুতিও লক্ষণীয়।

৫. লক্ষণীয়, তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের নামকরণেও রয়েছে অভিনবত্ব। রেহানা (আগের চলচ্চিত্র ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র অন্যতম নারী চরিত্রের নামও রেহানা) মরিয়ম নূর নামের যে নারী চিকিৎসককে ঘিরে এই চলচ্চিত্র, তারই নামে চলচ্চিত্রটির নামকরণ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা বেশি নেই।

লাইভ ফ্রম ঢাকা ছবির পোস্টার

৬. অতর ধারার পরিচালকদের অনেকেই সাধারণত নিজের রচনা ছাড়াও পরিচালনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সংগীত রচনাসহ চলচ্চিত্রের অনেক কাজ নিজেই করে থাকেন। সাদও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাদ নিজে করে থাকেন। সেটি হচ্ছে সম্পাদনা। চলচ্চিত্রের জন্মটা সম্পূর্ণ হয় সম্পাদনার টেবিলে আর সেটাই সাদ করেছেন তাঁর দুটো চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই।

৬. ওতাগ্হ্ ধারার পরিচালকদের অনেকেই সাধারণত নিজের রচনা ছাড়াও পরিচালনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সংগীত রচনাসহ চলচ্চিত্রের অনেক কাজ নিজেই করে থাকেন। সাদও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাদ নিজে করে থাকেন। সেটি হচ্ছে সম্পাদনা। চলচ্চিত্রের জন্মটা সম্পূর্ণ হয় সম্পাদনার টেবিলে আর সেটাই সাদ করেছেন তাঁর দুটো চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
সংগৃহীত

৭. কানের মতো উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগ ‘আঁ সার্তে রিগা’য় (অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে) আমন্ত্রিত সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ বাংলাদেশের একমাত্র চলচ্চিত্র, যার প্রধান কলাকুশলীর সিংহভাগ দেশের (একমাত্র শব্দকুশলী সার্বিয়ান নিকোলা মেডিচকে বাদ দিলে)। বিশেষ করে এখানে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল উপাদান দৃশ্য ধারণের (সিনেম্যাটোগ্রাফি) কাজ করেছেন সাদের জুটি শিল্পীবন্ধু তুহিন তমিজুল, যিনি আগের চলচ্চিত্র ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’রও দৃশ্যধারক (সিনেম্যাটোগ্রাফার)। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’য় দৃশ্য ধারণের কাজটি কিন্তু করেছিলেন ভারতের সুধীর পালসেন।