‘হে মহান, তোমার অস্থিমজ্জা ও মাংস আজ কবরে প্রোথিত।’ মঞ্চের আলো নিভে যাওয়ার আগে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পড়তে থাকেন মৌলভি আবদুল হালিম ও তাঁর স্ত্রী। নেপথ্যে হেলিকপ্টারের আওয়াজ। আস্তে আস্তে সেই আওয়াজও মিলিয়ে যায়। মিলনায়তনে আলো জ্বলে ওঠে। সে আলোতে দেখা গেল কয়েকজনের চোখ জলে ছলছল। এইমাত্র ‘জনকের অনন্তযাত্রা’র শেষ দৃশ্য দেখলেন তাঁরা।
ঢাকার মঞ্চে গতকাল এসেছে নতুন নাটক ‘জনকের অনন্তযাত্রা’। রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির মূল মিলনায়তনে এ নাটকের দ্বিতীয় প্রদর্শনী। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মাসুম রেজা। শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় এ নাটকে অভিনয় করেছেন ২২ শিল্পী। তাঁরা একেকজন একেক দলের কর্মী। কেউ আবার দীর্ঘদিন মঞ্চে ছিলেন না। কাউকে কালেভদ্রে দেখা যেত। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে মহড়ায় প্রথমবার এক হয়েছিলেন সবাই। তারপর নিয়মিত মহড়া। তারও আগে প্রায় তিন মাস শিল্পী-কলাকুশলীরা নাটকটি নিয়ে অনলাইনে আলোচনা করেছিলেন।
এই নাটকের মাধ্যমে অনেক দিন পর মঞ্চে ফিরেছেন আজিজুল হাকিম, মুনিরা ইউসুফ মেমী ও কামাল বায়েজিদ। বঙ্গবন্ধুর দাফন যেন ধর্মীয় বিধিবিধান মোতাবেক হয়, তার জন্য প্রথম সোচ্চার হন টুঙ্গিপাড়ার মাওলানা আবদুল হালিম। সেই চরিত্রেই অভিনয় করছেন আজিজুল হাকিম। তাঁর স্ত্রীর চরিত্রটি করেছেন মেমী। আর কামাল বায়েজিদ হয়েছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। নাটকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কর্নেল রউফ। সেই চরিত্রে অভিনয় করছেন সায়েম সামাদ। আরও অভিনয় করেছেন খন্দকার তাজমি নূর, মারুফ কবির, সাইফুল জার্নাল, নাজমুল আলম, ইব্রাহীম হোসেইন, তারেক আলী প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে সমাহিত করার ঘটনা নিয়ে ‘জনকের অনন্তযাত্রা’। নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম রেজা বলেন, ‘ইতিহাস সংরক্ষণের ইচ্ছা থেকে এ নাটক লেখা, এমনটি নয়। এ রচনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্টের ঘটনাগুলোকে গল্পের আশ্রয়ে উপস্থাপন করা।’
মাসুম রেজা আরও বলেন, ‘১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সংগঠিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। পরদিন ভোরে পরিবারের সবাইকে সমাহিত করা হয় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে। কেবল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ায়। একজন রাষ্ট্রপতিকে তাঁর শেষ শয্যায় শায়িত করা হবে, অথচ নেই কোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজন। কী নিদারুণ অবহেলা!
ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সেদিন ছুটে এসেছিলেন আশপাশের সাধারণ মানুষ। একজন মুসলমানকে যেভাবে সমাহিত করা হয়, সেভাবেই হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ শয়ান। সেদিন যাঁরা সেই শোকার্ত আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মুখ থেকে শোনা ইতিহাস স্থান পেয়েছে নানান জায়গায়, নানানভাবে। বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করার পূর্বাপর ঘটনাগুলো আমাদের অনেকের কাছেই অস্পষ্ট বা অজানা। নানান তথ্য, তত্ত্ব ও গবেষণার মাধ্যমে ১৬ আগস্টের সারা দিনের খণ্ড খণ্ড চিত্র জোড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে “জনকের অনন্তযাত্রা” নাটকের গল্প। এককথায়, এ নাটকে সেদিনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে গল্পনির্ভর, আর গল্পটা হয়েছে ইতিহাসনির্ভর। নাটকটি ইতিহাসের নিংড়ানো নির্যাস, এক নির্মম বেদনাগাথা।’
কয়েক বছর আগে আরণ্যক নাট্যদলের ‘ইবলিশ’ নাটকে শেষ অভিনয় করেন আজিজুল হাকিম। নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা আজিজুল হাকিমকে ঢাকার দর্শক দীর্ঘদিন পর নতুন কোনো মঞ্চনাটকে দেখলেন শনিবার। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ প্রদর্শনীতে অভিনয় করলেও এই দীর্ঘ সময়ে নতুন কোনো নাটকে তাঁকে দেখা যায়নি।
আজিজুল হাকিম বলেন, ‘আমাকে অভিনেতা হিসেবে তৈরি করেছে মঞ্চ। কিন্তু টিভি নাটকের ব্যস্ততার জন্য অনেক আগেই মঞ্চনাটক করা ছেড়ে দিই। তবে মাঝেমধ্যে দলের পুরোনো নাটকে অভিনয় করেছি। নতুন কাজটির প্রস্তাব পাওয়ার পর দেখলাম, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। একটি ভালো কাজ দিয়েই নতুন করে মঞ্চে ফিরেছি।’ এর আগে থিয়েটার আরামবাগের পুরোনো নাটক ‘বলদ’-এ অভিনয় করেন মুনিরা ইউসুফ মেমী। তিনি বলেন, ‘মঞ্চে কাজ করলে সিরিয়াসলি করতে হয়, সময় দিতে হয়। তাই সাহস পাচ্ছিলাম না। এবার মাসুম ভাই সাহস দেওয়ায় কাজটি করছি।’
নাটকটির প্রযোজনা উপদেষ্টা বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘বছরব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। তাঁর কর্ম ও কীর্তিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে শিল্পকলা একাডেমি নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে চলেছে। সেই কর্মসূচিরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় প্রযোজনায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকটি। এই নাটকের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ানুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করবে বলে আমার বিশ্বাস।’