নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পারব

সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত নতুন নাটক ’বিস্ময়কর সবকিছু’ নিয়ে মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে স্পর্ধা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে নাটকটির। আজ ও কাল উত্তরায় সন্ধ্যায় নাটকটির প্রদর্শনী আছে। নতুন এ উদ্যোগ নিয়ে কথা বললেন নাটকটির প্রধান অভিনেত্রী মহসিনা আক্তার।

প্রশ্ন :

উদ্যোগ নেওয়ার পরে নাটকটি বাছাই করলেন, নাকি নাটকটি পাওয়ার পরে মনে হলো, এমন উদ্যোগ নিয়ে এই নাটকটি করা যায়?

আমরা ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’ করার পরে নাটক খুঁজছিলাম। এটা ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’ করার আগেই হাতে ছিল। এটা নিয়ে মনে হলো যে প্যানডেমিকের সময়, খুব অল্প পরিসরে কার্যকরী হতে পারে। কারণ, শুধু দর্শকের কাছে নাটক নিয়ে পৌঁছালে তো হবে না; যাতে অর্থপূর্ণ হয়, সেটাও ভাবতে হবে। দর্শককে একটা নতুন কিছু দেবে। দর্শক নতুন করে ভাববেন। আমি অভিনেতা হিসেবেও নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পারব এবং নির্দেশকের জন্যও সেটা নতুন হবে।

মিলনায়তনে নয়, এই শহরের নানান বাড়ির বসার ঘরেই প্রদর্শিত হচ্ছে নাটক ‘বিস্ময়কর সবকিছু’
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

ব্যাপারটা কি এমন যে উত্তরা কিংবা গুলশানে মঞ্চ থাকলে আর এই ড্রয়িংরুমে নাটক করার উদ্যোগ নিতেন না! নাকি এটা একেবারেই নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে ভিন্ন একটি ফর্ম?

এটা মঞ্চে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার আছে, সেটা হলো প্রত্যেক দর্শক যেন প্রত্যেককে দেখতে পারেন, অভিনেতাকে দেখতে পারেন। ব্যাপারটা এমন নয় যে একজন দর্শক শুধু হলের এক কোণে বসে অভিনেতাকে দেখতে পারলেই হয়ে গেল। এখন এটা হতে পারে হলেও। এখন হল মানেই যে একটা প্রসেনিয়াম (যেখানে একদিকে পারফরম্যান্স হয় এবং বিপরীত দিকে দর্শক বসেন) মঞ্চ থাকতে হবে তা নয়। এমন হতে পারে, উত্তরাতে একটা হলরুম থাকল। কিংবা দুটি, তিনটি, পাঁচটি হলরুম থাকল। সেটা হয়তো চার কোনা একটা ঘর, যেখানে মানুষ সংস্কৃতিচর্চা করবে। শুধু নাটক করবে তা নয়। সে রকম জায়গায়ও এই নাটক উপস্থাপন হতে পারত। কিন্তু সেটা যেহেতু নেই, এ কারণে আমরা খুঁজছি যে কী আছে তাহলে? উত্তরায় কারা আছে, যাদের কাছে এমন চার কোনা জায়গা পাওয়া যাবে। তখন আফসানা মিমি আপার কাছে একটা জায়গা পাওয়া গেল। নামটা এই মুহূর্তে মনে নেই। ওটার নিচে একটা ঘর আছে, যেটা হয়তো ড্যান্সের জন্য বা কোনো ওয়ার্কশপ কিংবা সেমিনারের জন্য ব্যবহার করে। ওটা আমাদের দিলেন। বললেন, এখানে আপনারা করতে পারেন। সাইফ সুমন বলেছেন, তাঁদের সেগুনবাগিচায় একটা মহড়াকক্ষ আছে, ওখানে করতে পারি। একজন বলেছেন, বাসাবোতে করলে ওনারা খুশি হবেন। এখন এটা এভাবে ছড়াচ্ছে।

প্রশ্ন :

নাটক দেখার ক্ষেত্রে মোটাদাগে মঞ্চ ও পথনাটকের দুটি ফর্ম সাধারণত আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি চলে আসছে। নাটক করা ও দেখার ক্ষেত্রে এই গতানুগতিক ধারার বাইরেও দর্শকের কাছে পৌঁছানো যায় নাটক নিয়ে?

একদম। ব্যাপারটা এ রকম যে আমাদের বাইরেও হয়তো কেউ এই চেষ্টা করছেন। তবে ব্যাপারটা যেন এমন না হয় যে জোর করে এটি করার জন্য করছি। এভাবে করতে হবে, এটা যেন মুখ্য না হয়ে দাঁড়ায়। নাটকটি যেন অর্থপূর্ণভাবে হয়ে ওঠে।

‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটকের দৃশ্য
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

একটা কথা চালু আছে, থিয়েটার করা হলো নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো! গ্রুপ থিয়েটার চর্চার বাইরে গিয়ে আপনারা ‘স্পর্ধা’ নামে নাটকের কাজ শুরু করলেন। এটা নিয়ে তিনটি প্রযোজনা হলো। আর্থিক স্বাবলম্বিতা কি তৈরি হলো বা এটা নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন?

সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কাজটা সহজ নয়। কিন্তু এটা একেবারে হয়তো অসম্ভবও নয়। আমরা যারা আছি, প্রায় ফুলটাইম কাজ করি। অবশ্যই চিন্তা আছে অন্তত এখান থেকে আর্থিক সুবিধার একটা জায়গা তৈরি করতে। হয়তো সেটা সামান্য। যখনই আমি বলি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, তখনই কিন্তু একটা সুযোগ আমার জন্য রেখে দিই কাজের মানের ক্ষেত্রে। আমরা যারা এ বিষয়ে পড়েছি, আমরা যারা ভালোবাসি, কাজটা করতে চাই—ভালো না লাগলে তো আর এভাবে করা সম্ভব নয়। এখান থেকে কিছুটা ছাড় তো দিতেই হয় জীবনে। ওই চকচকে লোভটা ছেড়ে এটার পেছনে লেগে থেকে দেখি, আসলেই কী হয়। সেদিক থেকে আমরা চেষ্টা করছি নাটকের মাধ্যমে নাটক করার ব্যয়টা যেন তুলতে পারি। এই নাটকের খরচটা আমরা কীভাবে তুলেছি। আমরা এর আগে দুটি ওয়ার্কশপ করিয়েছিলাম। ওখান থেকে ওয়ার্কশপের খরচের বাইরে একটা টাকাও আমরা নিইনি। ওই উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে কিন্তু এই প্রযোজনাটি করেছি। এভাবে আমরা চেষ্টা করছি একটা উপায় বের করার, যেটা দিয়ে নাটক করা যায় এবং অন্তত যাতায়াত খরচটা মেটানো যায়।

প্রশ্ন :

এই উদ্যোগে অন্য কোনো নাটক নিয়ে আসবেন?

নিশ্চয়ই। মঞ্চে আবার আসব। তবে এই উদ্যোগে নতুন নাটক আসবে কি না, এখনই বলতে পারছি না। দর্শক যত দিন চাইবেন, তাঁদের ঘরে হোক, তাঁদের কনফারেন্স রুমে হোক—চট্টগ্রামের একজন বলেছেন, তাঁদের ওখানে করতে চান। এ রকম যদি দর্শকেরা করতে চান, আমাদের এটা চলতে থাকবে। পরে চিন্তা করব। ওয়ার্কশপের খুব চাপ আছে। এটার পরে আবার ওয়ার্কশপ শুরু করতে পারি।

এই নাটকে অভিনশিল্পীর কো-অ্যাক্টর দর্শক
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

এ ধরনের পারফরম্যান্সে মূল চ্যালেঞ্জ কী?

এই নাটকের ইন্টারঅ্যাকশনটা একদমই দর্শকের সঙ্গে। আমার কো-অ্যাক্টর দর্শক। আমি যত কাজ করেছি, তার মধ্যে এটা আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ। এটা আসলেই আমাকে শেখাচ্ছে যে মনোযোগ (কনসেনট্রেশন) আর যোগাযোগ (কমিউনিয়ন) আসলে কী? প্রতি মুহূর্তে মনোযোগ রাখতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন কমিউনিয়ন তৈরি করতে হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরপরই নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। প্রতিটি ধাপে আমাকে প্রবলেম সলভ করে যেতে হচ্ছে। কারণ, প্রায় পাঁচটি চরিত্র আমার সঙ্গে অভিনয় করে। পাঁচজন প্রায় দশবার অভিনয় করেন। তিনি কিন্তু করার জন্য প্রস্তুত নন। কিন্তু কালকে অবাক করার মতো অভিজ্ঞতা হলো। প্রথমে যিনি করলেন, তিনি একটু নার্ভাস ছিলেন। পরে যাঁরা এলেন, তাঁরা কিন্তু অভিনয় করে গেলেন। আমাকে অনেক বেশি সাহায্য করছিল। অবাক কাণ্ড, আমি যাঁকেই বলছি, তিনি রাজি হচ্ছেন। বললাম, আপনি কি আমার সেই অমুক আপা হবেন? আপনি কি আমার বাবা হবেন? সবাই রাজি হচ্ছেন। আমরা আশা করিনি তাঁরা এমন কথা বলবেন। এটাও গতকাল হয়েছে।

প্রশ্ন :

একটু বিস্তারিত বলবেন?

যেমন এই নাটকটি বিষণ্নতা নিয়ে। একজন মেয়ের মা সুইসাইড করে। সে মেয়েটা খুঁজতে থাকে মায়ের জন্য এমন কিছু, যা হলে মায়ের মনে হবে জীবনে বাঁচার অর্থ আছে। সে সুন্দর সুন্দর বিস্ময়কর বিষয়গুলো মাকে দেখানো শুরু করে। মাকে বাঁচাতে পারে না। একসময় এই মেয়েটা তার আনিকা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে। যেহেতু তার মা প্রায় সময়ই সুইসাইড অ্যাটেম করে। হাসপাতালে থাকে। তো আনিকা ম্যামকে ওই মেয়েটি বড় হয়ে ফোন দেয়। তখন ওই দর্শক নিজেই বলছিলেন, তোমাকে খুব মনে আছে, তুমি খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলে। এমন কিছু কিন্তু নাটকে নেই কোথাও। নিজেই ইমপ্রোভাইজ করে বলছিলেন। বলছিলেন, তোমার যখন দরকার হবে, আমাকে ফোন করবে। কারণ, তুমি তালিকা লিখছ। আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসতাম। এভাবে তিনি বললেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি আমাকে বুদ্ধি দিচ্ছেন কীভাবে বিষণ্নতা থেকে বেঁচে থাকতে পারো। এ ছাড়া তার আগের দিন একজন দর্শক বলেছিলেন, তুমি মাঝেমধ্যে আমার বাসায় এসো। এমন না যে তাঁকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি জানেন নাটক সম্পর্কে। তিনি গল্পের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে আমার সঙ্গে বলে যাচ্ছেন।

‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটকের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন আসাদুজ্জামান নূর
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আমাদের এই যাপিত জীবন কি দিন দিন শিল্প-সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে?

আমার একরকম শঙ্কা হয় যে আমরা যারা নাটক করি, বাইরে যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবন দেখি, আমার একটু শঙ্কা হয়। একটু দুশ্চিন্তা লাগে, এই চর্চাটা কমে যাচ্ছে। বাড়িতে চর্চা কমে যাচ্ছে। যেমন আমাদের বাড়িতে আমার একটা হারমোনিয়াম ছিল। আমি গান গাইতে পারি না। তবুও আমার একটা হারমোনিয়াম ছিল। আমরা বেশ কয়েকজন রেওয়াজ করতাম। এখন আমার গ্রামের বাড়িতে গেলেও কারও রেওয়াজের শব্দ শোনা যায় না। আপনি যে এরিয়াতেই থাকুন, খুব একটা সারগামের আওয়াজ সকালবেলা শুনতে পাবেন না। আমার মনে হয়, এটা ভয়ংকর। আশপাশের পরিবার, আমার আত্মীয়স্বজনের দিকে তাকালেও একটা ঘাটতি দেখা যায়। আমার কাছে মনে হয় এটা শঙ্কার। আবার অপর দিকে কিছু মানুষ যাঁরা নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, কিন্তু কাজ করতে চাচ্ছেন। আমাদের ওয়ার্কশপে যেমন ইঞ্জিনিয়ার এসেছিলেন। তখন আশা জাগে। কিন্তু সংকট একটা আছে। এর পরিবর্তন খুব জরুরি ভবিষ্যতের জন্য।