প্রশ্ন :
পিয়ানো লাউঞ্জে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?
মানাম (আহমেদ) ভাইয়ের সঙ্গে আগে কখনো কাজ করিনি। এই পিয়ানো লাউঞ্জ তো আমি প্রথমে বুঝিই–নি। প্রস্তাব পেয়ে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে খুব সাহস দিলেন। বললেন, আপনি আপনার মতো করে গানগুলো করেন। বাকিটা আমরা দেখব। শেষে দেখলাম, খুবই ভালো লাগল। এমন অনুষ্ঠানে গাওয়ার অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। পাঁচটি গান গেয়েছি।
প্রশ্ন :
আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গে লোকগান কেমন লাগে?
যুগে যুগে প্রযুক্তি আসবে। প্রযুক্তি আমাদের কৃষ্টি–সংস্কৃতিকে সহযোগিতা করবে। আমি মনে করি, এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। তবে সবার কাছে অনুরোধ করব, লোকগানে শিকড়ের গন্ধটা নষ্ট না করে যা খুশি যেন করে। আর তারা নিশ্চয় আমাদের চেয়ে অনেক ভালো বোঝে।
লালন ফকিরের আবির্ভাবের সময় তো এত যন্ত্রপাতি ছিল না। এখন তো অনেক কিছু হয়েছে। আর সবকিছু আমাদের সেই কথা ও সুরে সহযোগিতা করছে, এটা বড় পাওয়া। এতে করে গানটা আরও নতুন শ্রোতার কাছে ছড়াচ্ছে। আগে বাউল গান শুনত মুরব্বিরা, বয়স্ক লোক ছাড়া বুঝত না—আমাদের এ রকম একটা ধারণা ছিল। এখন আর কথাটা ঠিক নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউল গান নিয়ে পড়াশোনা হচ্ছে, গবেষণা করছে। দেশ বাউল গান নিয়ে ভাবছে, গণমাধ্যমও বাউল গান নিয়ে ভাবছে। আমাদের সবার ধারণারই অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
প্রশ্ন :
নতুন কাজকর্মের কী অবস্থা?
এই প্রজন্মের অনেকে দারুণ সব গান লিখছে। তাদের গানও গাইছি। ভালোই লাগছে। এটাকে আমি ফিউশন মনে করছি। একটা প্রজন্মের সঙ্গে আরেকটা প্রজন্মের সম্পর্ক হচ্ছে। অনেকে আমাদের নাতির বয়সী, তারা আমাদের সঙ্গে এসে কীর্তন করছে। এর মধ্যেই নতুন গানও আসবে। আগে তো ৮-১০টা গান দিয়ে একটা অ্যালবাম হতো, এখন তো একটা গান নিয়েই একটা অ্যালবাম।
প্রশ্ন :
আপনি তো চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।
হাতে গোনা কয়েকটি গান গেয়েছি। সর্বশেষ কাঠবিড়ালি চলচ্চিত্রে গাই। যত দূর মনে পড়ে, ঘেটুপুত্র কমলা এবং ভারতীয় একটি চলচ্চিত্রেও গেয়েছি, নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
প্রশ্ন :
আরও গাওয়ার ইচ্ছা আছে কি
ওভাবে বলতে চাই না যে আমাকে কেন ফিল্মে গান গাইতে দেওয়া হচ্ছে না। আমার এই কণ্ঠ যদি কোনো চলচ্চিত্রে দরকার পড়ে, আমার দিকে যদি এগিয়ে আসে, আমিও এগিয়ে যাব।
প্রশ্ন :
করোনার এই সময়ে আপনারা লোকগানের শিল্পীরা কেমন আছেন?
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি একা ভালো থাকলে তো ভালো থাকা নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর বাউলেরা কাজ শুরু করেছে। সবাই সামাল দিয়ে উঠবে আরকি। তবে ভবিষ্যতে যদি এ রকম কষ্ট আসে, তাহলে আর দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। বাঙালি পরিশ্রম করতে পারে, বাউলেরাও পরিশ্রম করতে পারে। যদি ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকে, আমরাও সামাল দিয়ে উঠব ইনশা আল্লাহ।
প্রশ্ন :
আপনারা যাঁরা বাউল গান করছেন, তাঁদের জন্য কর্মপরিবেশটা এখন কেমন?
মোটামুটি ভালো। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে একটু পিছিয়ে গেছি। সমাজ এখন বাউলদের অন্য চোখে দেখে। বাউলদের গান শুনে বোঝার চেষ্টা করে। আমরাও বোঝার চেষ্টা করি। শিক্ষিত মানুষেরা এদিকে এগিয়ে আসছে। সবাই সবার দিকে নজর রাখছে। বাউলেরা এখন অনেক সংগঠিত। এভাবে চললেই হয়। তবে বাউলেরা তো স্বভাবতই একটু সরল-সহজ। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা নেই আরকি। তবে আমাদের পাশে এসে এখন মানসিকভাবে শক্ত মানুষ দাঁড়াচ্ছেন। শিল্পকলা এবং আখড়ায় আখড়ায় বাউলেরা চর্চা করছেন। বড় বড় গবেষকেরা বাউল গানের ওপর ডক্টরেট করছেন, গবেষণা করছেন। আমাদের কোনো সমস্যা হলে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশের লোকগান নিয়ে আপনার স্বপ্ন?
বাংলাদেশের লোকগান সারা পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার, শুধু বাউলদের নয়। লোকগান আমাদের ঐতিহ্য। এমন দিন আসবে বাউলেরা আর উপেক্ষিত থাকবে না। বাউলদের মধ্যেও সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা হবে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চাটাই হলো মূলত আমাদের কাজ।
প্রশ্ন :
সুস্থ সংস্কৃতির কথা কেন উঠছে?
লালন ফকিরের বাউল গানগুলো নিয়ে মৌলবাদীরা অপব্যাখ্যা করে। বাউলেরা কিন্তু কখনো কোনো ধর্মকে আঘাত দিয়ে কথা বলে না। নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে মানবতার কথা বলে। অনেক সময় বাউলদের সম্পর্কে বলা হয়, ওরা নেশা করে, গাঁজা খায়, অমুক-তমুক বলে গালিও দেয়। আমরা মানুষকে বুঝিয়ে দিতে চাই, আসলে লালন ফকির মোটেও এসব নয়। তিনি ছিলেন শুদ্ধাচারের মানুষ। আরে আপনি যে দোষে আমাদের দোষী করছেন, এ দোষে দোষী সারা বিশ্বের মানুষ—সবাই তো লালন চর্চা করে না। সর্বস্তরের মানুষ এই জায়গায় আটকে পড়েছে, আর দায়ভার বহন করছে লালন ফকিরের অনুসারীরা। আসলে কিন্তু তা না, ওটা একটা নিরাপদ জায়গা, ওখানে মানুষ সবকিছু স্বাধীন ও নিরাপদভাবে করতে পারে, তাই সবাই ওখানে আশ্রয় নেয়। তার মানে যারা লালনাশ্রয়ী, তারা শুদ্ধাচারের মানুষ।