গাজী মাজহারুল আনোয়ার
ছবি : সংগৃহীত

শুভ জন্মদিন।

ধন্যবাদ।

জন্মদিন এলে কেউ বলে বয়স বাড়ে, আয়ু কমে। আপনার কাছে এই দিনটার অনুভূতি কী?

মানুষের কেউই চায় না যে আমি বুড়ো হয়ে যাই। কিন্তু আমার অনুভূতিতে আরেকটা জিনিস কাজ করে, কোন বয়সে কতটুকু করে যেতে পারলাম। সচেষ্ট হয়ে সেটাই চেষ্টা করি, চেতনা দিয়ে ভাবি, চিন্তা করে করে লিখি। এটা–ওটা করে যাচ্ছি আরকি। সৃজনশীলতার মধ্যে যত দিন বেঁচে থাকতে পারি—এটাই তো আমার চাওয়া। সৃজনশীল মানুষেরা সৃজনশীল অবস্থা হারিয়ে ফেলে, পূর্বপুরুষের পরিচয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকব—এটা কেউই প্রত্যাশা করে না। সময় এমন একটা জিনিস, মানুষকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। কাউকেই দাঁড় করিয়ে রাখে না। আমার এই বয়সেও কনফিডেন্স আছে, ভালো করতে পারব—এটাই বিশ্বাস করি। সেই প্রতিজ্ঞায় যত দিন পর্যন্ত আমার শারীরিক সুস্থতা থাকে, মানসিকভাবে যত দিন দৃঢ়তা প্রকাশ করতে পারি, তত দিন পর্যন্ত হারাব না, গান লেখাও ছাড়ব না। সংস্কৃতির কোনো অঙ্গনকেই আমি কোনো অবস্থায় ছাড়ব না। আমি যে শব্দগুলো চারপাশে শুনি—পরিবেশ নাই, এই কথার ওপর আমি আস্থাশীল নই।

আপনি তাহলে কী মনে করেন?

আমি মনে করি, পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব মানুষের। সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হচ্ছে মানুষ। তো সেই আমি পরিবেশ নিয়ে ভাবলেই তো পরিবেশটা সৃষ্টি করতে পারব। উদাহরণ হিসেবে বলব, আমার অত্যন্ত গরম লাগলে ভাবব ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে থাকতে হবে। অত্যন্ত উষ্ণতা লাগলে, আমি ভাবব বৃষ্টি হলে এই মুহূর্তে আমার ভালো লাগবে। এ জন্য অপেক্ষা করব, সংগ্রাম করব, এটার নামই তো জীবন। মানুষের জীবনটাকে আগেই কেন ব্যর্থ করে দেব? হয়তো আমি একসময় নিজেই বুঝব, একটা সময় আমার যোগ্যতার অভাব হচ্ছে। অথবা গ্রহণযোগ্য মানুষের কাছ থেকে ক্রমাগত ছিটকে পড়ছি। কিন্তু যত দিন পারব সংগ্রামটা চালিয়ে যাব।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

পরিস্থিতি ভালো না, পরিস্থিতি অনুকূলে না—এই কথাগুলো আসলে কারা বলে?

অপদার্থ ও হতাশাগ্রস্ত লোকেরা এমন কথা বলে।

এসব অপদার্থ ও হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যাপারে কী বলবেন?

যোগ্য মানুষকে পরাজয় স্পর্শ করতে পারে না। তবে মেধাবীরা হয়তো এসব অপদার্থ ও হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির কারণে সাময়িক কিছুটা ডিস্ট্রাক্ট হয়, কিন্তু ডিটারমাইন্ড হওয়ার কারণে এসবকে অতীত করে তারা বলবে, হোয়াই নট। পারব না কেন। একটা ছেলে একবার মেট্রিক পাস না করবে বলে যদি পড়াশোনা ছেড়ে দেয়, তাহলে তো হবে না। তাকে ফাইট করতে হবে। একদিন তার মধ্যে সব প্রাপ্তি আসবে। যারা দুর্বল হয়ে আত্মসমর্পণ করল, তারা তো এমনিতে কর্মহীন হয়ে উঠল। পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে। আকাশের মধ্যে যদি বৃষ্টি না থাকে, তাহলে কি আবহাওয়া দূষিত হয়ে যাবে? আমরা তো সেচব্যবস্থা দিয়ে মাটিকে উর্বর করব, তাই না। এরপর উর্বর মাটিতে আমরাই তো ফসল ফলাব। এই চিন্তা যাদের মাথায় নেই, তারা কখনোই সৃজনশীল কর্মী হিসেবে সার্বিকভাবে সার্বিক কোনো মঙ্গল দেশের জন্য করতে পারবে না। অতএব এটার জন্য ডিটারমিনেশন লাগবে, সংগ্রাম করতে হবে। যারা সংগ্রামের জন্য নিবেদিত, তাদের জন্য পরিবেশ কোনো সাবজেক্টই না, তাঁরাই পরিবেশ তৈরি করে।

এই মুহূর্তে আপনার প্রত্যাশা কী?

প্রত্যাশা একটাই করি, যেই দেশে আমার জন্ম, যেই মাটির গন্ধে আমি বড় হয়েছি, যে মাটির আকর্ষণে আমি এখনো বেঁচে আছি—যেই মানুষগুলোর ভালোবাসায় আমি গাজী মাজহারুল আনোয়ার হয়ে আছি—তাদেরকে বঞ্চিত করার অধিকার আমার নেই। আমি সংগ্রাম করে যাব শেষ পর্যন্ত। আমি বলব না পরিবেশ নাই, আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করব। আরব দেশে গরম আবহাওয়া, তাই বলে সেচব্যবস্থা চালু করে ফসল ফলাচ্ছে না?

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

আপনার পরে অনেকেই গান লিখছেন। নতুন প্রজন্মের গান লেখালেখি নিয়ে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই।

আমি বলব না, নতুন হয়ে গান লিখে একদিন কেউ অবাক কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। সব কটি সৃষ্টির পেছনে পরিশ্রম লাগে। প্রতিভা লাগে এবং প্রতিভাকে চর্চায় রাখতে হয়। তারা যদি মনে করে, এই কর্মটাকে নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হবে, তাহলে সংগ্রাম করতে হবে। সংগ্রামী চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শব্দ তো সবার মাথায় আসে। এই শব্দ প্রয়োগের কারণেই একজন মানুষ বলবে, সে খুব ভালো কথা বলে, আরেকজন বলবে, না সে তো বাজে কথা বলে। শব্দ প্রয়োগের চেষ্টা করে সুন্দরতম অবস্থানে তো আমাকে নিয়ে যেতে হবে। জ্ঞান দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আমি মনে করি, কিছুই ধ্বংস হয় না। পুরোনো জিনিস পরিবর্তন হবে, এরপর নতুন জিনিসই আবার সৃষ্টি হবে। সেই নতুনত্ব দিয়ে আমরা আবার নতুনভাবে উৎসাহিত করে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করব। এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যারা আছে, তাদের দ্বারাই এগোবে, অন্যদের দিয়ে হবে না।

দেশের সব গীতিকবি, সুরকার, সংগীত পরিচালক, সংগীতশিল্পী, সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন আপনি সফল ও সার্থক গীতিকবি, পরিচালক ও প্রযোজক। আপনি নিজেকে কতটা সফল ও সার্থক মনে করেন?

সার্থক মনে করি যখন দেখি সবার ভালোবাসায় আমি সিক্ত হয়েছি। ব্যক্তিজীবনে আমার কিছু অপারগতা এবং ব্যর্থতাও আছে—আমি যা করতে চাই, তা পারছি কি না, এ নিয়ে নিত্যই দ্বন্দ্বে থাকি। তবে সৃষ্টিকর্তার রহমত এবং সবার ভালোবাসা ও দোয়ায় এখন পর্যন্ত অকৃতকার্য হওয়ার মতো কোনো ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি অন্তত সৃজনশীল কর্মে। অতএব আমার বয়সের ভারে ক্লান্ত না হয়ে যেন সবার ভালোবাসায় আর সংগ্রামী হয়ে এগিয়ে যেতে পারি। মৃত্যুর সময় আমার হাতে যেন কলম থাকে—এটাই আমার চাওয়া।

সিনেমা পরিচালনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন কেন?

গুটিয়ে নেওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। সবকিছুর মধ্যে ক্রমাগতভাবে আমাদের কিছুটা দৈন্য এসে গেছে। যেকোনো সৃজনশীল কর্মই করি না কেন, আমার বুঝতে হবে, কাদের জন্য লিখছি, কাদের জন্য চলচ্চিত্র বানাচ্ছি এবং কী করতে চাই এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। অনেকেই বলেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিক্ষা হয়। একটা বাড়িতে দাওয়াতে গিয়ে যদি যতটুকু দরকার তার চেয়ে বেশি খেলে, সেই খাদ্যটা বমি করেই ফেলে দিতে হবে। আমি কতটুকু পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারব এবং কতটুকু বর্জন করে আমি সুখে থাকতে পারব—এই পরিমিতি জ্ঞান থাকতে হবে, যেটাকে বলে সেন্স অব রেস্ট্রিকশন। এটাকে যেকোনো নির্মাতা সৃজনশীল ক্ষেত্রেই হোক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক, এটা যদি মনে রাখে, জিনিসটা কতটুকু মনে রাখার ক্ষমতা আমার দর্শকের, জনগণের মনে কতটুকু উচ্চতার মাপে আছে—তাহলে ব্যর্থতার কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। একটা কথা আছে, ওল্ড অর্ডার চেঞ্জেস ইয়েল্ডিং প্লেস টু নিউ, নতুনভাবে একটা স্বভাব নিয়ে হয়তো এগুলো আসতে পারে। আসলেও এমনভাবে আসতে হবে, সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতার ঊর্ধ্বে না ওঠে। গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে থাকতে হবে। আর সংস্কৃতিকে সুন্দরভাবে বাড়িতে আনতে হবে। যাঁরা ঔপন্যাসিক ছিলেন, এই শরৎচন্দ্রের কথাই যদি বলি, তাঁদের উপন্যাস আমরা রাতের অন্ধকারে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে পড়তাম। তার অর্থ, বিষয়বস্তু এমন আকৃষ্টসম্পন্ন ছিল, যা সারাক্ষণ না পড়লে ঘুমও আসত না। তো আমি মনে করি, সে ধরনের ওষুধ যদি আমরা সৃজনশীল কর্মের মধ্যে দিয়ে দিতে পারি, আমাদের সব রোগী ভালো হবে। ভালো হলেই আমাদের সৃজনশীল কর্ম সফল হবে। কি চলচ্চিত্রে, কি গানে, কি নাটকে—সবখানে হবে।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

এখনকার চলচ্চিত্রের গান শোনা হয় আপনার?

অবশ্যই শুনি। যেগুলো চলার সেগুলো চলছে, দেশে–বিদেশে সব জায়গায় চলছে। আমার কথা হচ্ছে, একটা জিনিস খেতে একটু ভালো লাগছে না। তাই বলে কি আমি অন্যভাবে খাওয়াটা তৈরি করতে পারব না। এই যে সংগ্রামটা তো করতে হবে। সব সময় কি মানুষ পোলাও–কোরমা খায়? একসময় ঝালঝোলও, তরকারি বা মাছও তো খায়। কী রুচির মধ্যে আমাদের শ্রোতারা আছেন, সেই রুচিরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে তাদের মতো করে কাজটা করতে হবে।

আপনার কাছে জীবন মানে কী?

জীবন মানেই সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম দিয়ে যখন তৃপ্ত হব, আমি মনে করব তখন জীবনের সার্থকতা। আমার অস্তিত্ব যাতে বিলীন না হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সব আমানত শুধু ভোগ করলেই হবে না, রক্ষা করে ত্যাগস্বীকার করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে।