নেটফ্লিক্সের পথে নতুন কাঁটা

নেটফ্লিক্সকে এখন আমাজন ও ডিজনির সঙ্গে লাভের গুড় ভাগ করতে হচ্ছে। সেই গুড়ে ভাগ বসাতে আসছে ওয়ার্নার মিডিয়া ও ডিসকভারি

করোনায় স্ট্রিমিং ব্যবসা রমরমা হয়েছে। আর নেটফ্লিক্সকে বলা হয় স্ট্রিমিং দুনিয়ার অগ্রদূত। বিশ্বজুড়েই ভিডিও স্ট্রিমিং দুনিয়ায় এখন সবার ওপরে আছে নেটফ্লিক্স। তবে নেটফ্লিক্সকে এখন আমাজন ও ডিজনির সঙ্গে লাভের গুড় ভাগ করতে হচ্ছে। সেই গুড়ে ভাগ বসাতে আসছে আরও এক পক্ষ। তার নাম ওয়ার্নার মিডিয়া ও ডিসকভারি। সম্প্রতি এই দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
গত মাসের মাঝামাঝি এ ঘোষণা দেয় ডিসকভারি ও ওয়ার্নার মিডিয়ার মালিক প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটি। টেলিকমিউনিকেশন ব্যবসার জন্যই বিখ্যাত এটিঅ্যান্ডটি। ১৮৭৭ সালে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন টেলিফোনের জনক বলে খ্যাত আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল। ২০১৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান মিডিয়া ব্যবসায় ঢোকে, কিনে নেয় টাইম ওয়ার্নার। পরে এর নাম হয় ওয়ার্নার মিডিয়া। হ্যারি পটার ও ব্যাটম্যান ফ্র্যাঞ্চাইজির সৌজন্যে বিখ্যাত ওয়ার্নার। নতুন চুক্তি অনুযায়ী এখন থেকে ডিসকভারির সঙ্গে এক হয়ে মিডিয়া ব্যবসা চালাবে ওয়ার্নার।

বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিক মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে বড় কোম্পানির দিক থেকে ডিজনির পরপরই জায়গা পাবে নতুন এই প্রতিষ্ঠান। আর এর মধ্য দিয়েই মিডিয়া ব্যবসায় আরও অনেক ছোট স্ট্রিমিং কোম্পানির একীভূত হওয়ার পথ তৈরি হলো। অদূর ভবিষ্যতেই এমনটা হতে পারে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

প্রশ্ন হলো, এতে নেটফ্লিক্সের দুশ্চিন্তার কারণ কী? এবার কিছু তথ্য জানা যাক। আপাতদৃষ্টে মনে হতেই পারে যে ওয়ার্নার মিডিয়া ও ডিসকভারির যুগলবন্দী ঠিক যায় না! কারণ, উঁচু মানের টিভি সিরিজ তৈরিতে খ্যাতি আছে ওয়ার্নারের। আর ডিসকভারি মূলত তথ্যভিত্তিক কনটেন্ট তৈরিতে দক্ষ। তবে যখন শুনবেন, এই দুই প্রতিষ্ঠান গত বছর কনটেন্ট তৈরিতে ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে, তখন কিন্তু নড়েচড়ে বসতেই হবে। কারণ, কনটেন্ট তৈরিতে এই পরিমাণ ব্যয় করতে পারে না নেটফ্লিক্স বা ডিজনিও। আমেরিকার কেব্‌ল দর্শকদের একটি বড় অংশও ওয়ার্নার ও ডিসকভারির দখলে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান মফেটনাথানসন বলছে, এ ক্ষেত্রে ওয়ার্নার ও ডিসকভারির সম্মিলিত দখল প্রায় ২৯ শতাংশ। আর একীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে এ যুগলের বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে।

একীভূত প্রতিষ্ঠানের ৭১ শতাংশের মালিক থাকবে এটিঅ্যান্ডটি। বাকি ২৯ শতাংশের মালিক ডিসকভারি। তবে মালিকানা কম থাকলেও নতুন কোম্পানি পরিচালনা করবেন ডিসকভারির প্রধান ডেভিড জাসলাভ। একীভূত প্রতিষ্ঠানটির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হবে ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসা। ওয়ার্নারের আগে থেকেই একটি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আছে, নাম এইচবিও ম্যাক্স। ডিসকভারিরও আছে নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম, ডিসকভারি প্লাস। নতুন কোম্পানির স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম কি একটি হবে, না একাধিক, তা নিয়ে তাই ধোঁয়াশা আছে। নতুন কোম্পানির পক্ষ থেকে এখনই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি।
ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে ওয়ার্নারের বিশ্বজুড়ে ছয় কোটি চার লাখ সাবস্ক্রাইবার আছে। ডিসকভারি প্লাসের আছে দেড় কোটি। এ ছাড়া অ্যানিমেল প্ল্যানেট ও ডিসকভারি চ্যানেলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ৮ কোটি ৮০ লাখ বাড়িতে ডিসকভারির দর্শক আছে। অর্থাৎ এই দুই কোম্পানির দর্শকশ্রেণি ছোট নয়। যদিও স্ট্রিমিং কোম্পানির হিসাবে এখনো নেটফ্লিক্স ও ডিজনির চেয়ে পিছিয়ে আছে একীভূত কোম্পানিটি। নেটফ্লিক্সের আছে ২০ কোটি ৮০ লাখ সাবস্ক্রাইবার আর ডিজনি প্লাসের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। সেই হিসাব মাথায় নিলে অবশ্য বলতে হয়, নেটফ্লিক্স বা ডিজনিকে পেছনে ফেলতে ওয়ার্নার ও ডিসকভারির সময় লাগবে বেশ। তবে তা যে অসম্ভব নয় একেবারেই, সেটি বুঝতে বিনিয়োগের পরিমাণ দেখাই যথেষ্ট।

ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসায় আগেই প্রতিযোগিতা ছিল। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতিতে তা আরও প্রবল হয়েছে। বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান মিডিয়া রিসার্চের জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রান্তিকে বিনোদনে ব্যয় করা সময়ের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল ১২ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্ব আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করায় সেই সময়ের পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আগের তুলনায় পরিমাণ কমেছে ২ শতাংশ পর্যন্ত। আর ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই এক হলো ওয়ার্নার মিডিয়া ও ডিসকভারি। সুতরাং স্ট্রিমিং তথা সার্বিক মিডিয়া ব্যবসায় প্রতিযোগিতা যে আরও তীব্র হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
এই প্রতিযোগিতায়ই এবার সগৌরব টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হবে নেটফ্লিক্সকে। একদিকে আমাজন ও ডিজনি, অন্যদিকে ওয়ার্নার-ডিসকভারি; এর মধ্যে কত দিন শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখে নেটফ্লিক্স, তা–ই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকনোমিস্ট, বিবিসি, সিএনবিসি, ভালচার ডট কম ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস