
গতকাল মঙ্গলবার চিরবিদায় নিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের বরেণ্য সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তরুণ বয়স থেকেই দেশের সংগীতাঙ্গনে তাঁর পদচারণ। দেশের গান তো বটেই, আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানে আছে তাঁর অবদান। তাঁকে স্মরণ করেছেন কয়েকজন সংগীতশিল্পী, সুরকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক।

স্বাধীন দেশে পরাধীন জীবন যাপন করে গেল
আলম খান, সুরকার ও সংগীত পরিচালক
১৯৭৮ সালে বুলবুল আমার কাছে আসে। আমার সঙ্গে সে কাজ করতে চায় সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে। আমি কথাবার্তা বলে চূড়ান্ত করি। তারপর টানা পাঁচ বছর আমার সহকারী হিসেবে কাজ করেছে বুলবুল। ওই সময়ে দেখেছি, তার সংগীত সম্পর্কে অগাধ পড়াশোনা ও জ্ঞান আছে, যেটা সে পুরো জীবন এই দেশের সংগীতাঙ্গনে দিয়ে গেছে।
ওর গানগুলোর মধ্যে দেশের গান তো বটেই, চলচ্চিত্রের গান, আধুনিক গান—সব জায়গায় সে একটা নিজস্ব ছাপ রাখত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, অনেক বছর বুলবুল একটা স্বাধীন দেশে পরাধীন জীবন যাপন করে গেল। এটা ভাবলে খুব কষ্ট হয়।
ওই সময়গুলোতে আমার সঙ্গে নিয়মিত মুঠোফোনে কথা হতো। শুধু এটুকু বলব, বুলবুলের মতো গুণী সংগীত পরিচালকের চলে যাওয়া মানে আমাদের একটা নক্ষত্রের চলে যাওয়া।

আমি ওর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম
গাজী মাজহারুল আনোয়ার, গীতিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক
বুলবুলকে নিয়ে অনেক কথাই বলতে পারি। শুরুতেই যেটা বলব, তা হলো, আমাদের সংগীতাঙ্গনে যদি ভিন্ন ধারার সংগীত পরিচালক এসে থাকে, সে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার ভেতর একটা বিদ্রোহী সত্তা সব সময় ছিল। জীবনের শেষ অবধি সেটা আমরা দেখেছি। যদি ভুল না করি, তাহলে আমার ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরুর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে পা রাখে বুলবুল। আমার নির্মিত চলচ্চিত্রে নিয়মিত সংগীত পরিচালক ছিলেন সত্য সাহা। কিন্তু আমি যখন নান্টু ঘটক ছবির নির্মাণ শুরু করি, তখন সত্য সাহা কী একটা কাজে মুম্বাই গিয়েছিলেন। আমি একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। তখন সাবিনা ইয়াসমীন আমাকে বললেন, ‘গাজী ভাই, তুমি এত চিন্তা করছ কেন, আমি একটা ছেলেকে পাঠাচ্ছি। তুমি তার সঙ্গে কথা বলো,
কাজ দেখো।’
তারপর এল বুলবুল। আমি তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এরপর নান্টু ঘটক ছবিতে সংগীত পরিচালনা করে বুলবুল। সে সবার চেয়ে আলাদা ছিল। সেই আলাদাটা ছিল দেশাত্মবোধে। কারণ সে বলত, ‘আমি যদি সবার মতোই কাজ করি, তাহলে মানুষ আমাকে কেন মনে রাখবে!’ আমি মনে করি, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে মনে রাখার অনেক কিছু আছে। নতুন প্রজন্ম তার গানের মাধ্যমে তাকে মনে রাখবে।

এভাবে চলে যাবে এটা ভাবিনি
এ্যান্ড্রু কিশোর, সংগীতশিল্পী
বুলবুলকে নিয়ে কী বলব! আসলে বলার মতো কিছু নেই। আমাদের শুধু শিল্পী আর সংগীত পরিচালকের সম্পর্ক ছিল না। আমরা ছিলাম বন্ধু। তা-ও পারিবারিক বন্ধু। ১৯৮০ সালের দিকে তার সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্ক। তখন আমাদের যৌবনকাল। তারপর তো অনেক কিছু হয়েছে। আমাদের সংসার হয়েছে, সন্তান হয়েছে। সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শেষ দিন অবধি ছিল আমাদের।
আমি তখন রাজশাহী থেকে গানের জন্য আসতাম, গাইতাম। তখন বুলবুল ছিল আলম খানের প্রধান সহকারী। নিয়মিত বুলবুলের বাসায় যেতাম। তারা দুই ভাই এক রুমে থাকত। সেই রুমে গিয়ে আড্ডা মারতাম আমরা। খালাম্মা চা দিতেন। কোনো দিন ভাত খেয়ে আসতে হতো। আমার সঙ্গে বুলবুলের সম্পর্ক ছিল এ রকম।
গত মাসের শেষ দিকে ক্রিসমাসের সময় আমি গিয়েছিলাম তার বাসায়। আমার স্ত্রী কেক বানিয়েছিল, সেটা নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘণ্টা দু-তিন ছিলাম। অনেক আড্ডা হয়েছে। কিন্তু এভাবে চলে যাবে, এটা ভাবিনি। আসলে যার যায়, সে-ই বোঝে।

আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল
সাবিনা ইয়াসমীন, সংগীতশিল্পী
আমার সঙ্গে বুলবুলের পরিচয় হয় ১৯৭৮ সালের দিকে। ওই সময় বিভিন্ন স্টুডিওতে বা গানের আড্ডায় কথা হতো আমাদের। কবে, কীভাবে পরিচয় হয়েছে, সেটা এখন আর মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে, আমাদের কলবাগানের লেক সার্কাসের বাসায় বুলবুল প্রায়ই আসত। তখন আমাকে বলত, ‘আপনার জন্য কিছু গান করেছি, একটু শুনতে হবে।’ কিন্তু শোনার সুযোগ সহজে মেলে না। এই করে অনেক দিন পার হয়ে গেল। একদিন সুযোগ মিলল। বুলবুলকে ডেকে শুনতে বসে গেলাম। বেশির ভাগই দেশের গান। দেশের গানও এমন হতে পারে! আমি অভিভূত হয়ে যাই। এরপর তার গানগুলো দিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান করলাম পরের বছর। অনুষ্ঠানটা ব্যাপক সাড়া ফেলে। তারপর নিয়মিতভাবে কয়েক বছরই তার গান দিয়ে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেছি। সবার একটা আগ্রহ থাকত অনুষ্ঠানটা নিয়ে।
আমার আর বুলবুলের মধ্যে গান নিয়ে বোঝাপড়াটা হতো খুব ভালো। আমার প্রতি তার একটা বিশ্বাস ছিল। বুলবুলের ধারণা ছিল, ‘তার গানের কথা, সুর—সবই আমি ভালো বুঝতে পারি। আমাকে প্রায়ই বলত, আপনি গাইলে আমার কোনো চিন্তা থাকে না। যেভাবে চাই, সেভাবেই পাই।’ আর আমি দেখতাম, তার গানের সবচেয়ে বড় শক্তিটা হলো, গান চোখের সামনে দেখতে পারা। গানের প্রতিটি কথা আমি চোখের সামনে দেখতে পারতাম। তবে শুধু দেশের গানেই নয়, চলচ্চিত্রের গানেও ছিল তার সমান অংশগ্রহণ।
ব্যক্তিগতভাবে আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তার পরিবারের সবার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল। গত বছরও বুলবুলের সুরে গান করেছি। মাঝেমধ্যে তো কথা হতো। বুলবুলের যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করত বারবার, সেটি হলো অত অল্প বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। শুনেছি, মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে ওই সময় ফিরে এসেছে সে। সেবার ফিরে এলেও এবার ফিরতে পারল না। একজন ক্ষণজন্মা হিসেবে বিদায় নিল বুলবুল।