তিনি বললেন, ‘কান্না থামাও, এত ইমোশনাল হতে নেই’
১৯৯৩ সালের কথা। এশিয়াটিকের উদ্যোগে একটি সৌন্দর্য সাবানের বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মিত হবে। মডেল নির্বাচন করা হলো আমাকে। বিজ্ঞাপনচিত্রটির শুটিং হবে মুম্বাই। এর আগে কখনো আমি মুম্বাই যাইনি। মুম্বাই যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই মনে মনে ভাবলাম, যদি সুযোগ হয়, যেভাবেই হোক একবার লতাজির সঙ্গে দেখা করব। কারণ তিনি আমার আইডল। শুধু আমার নন, লতাজি, সব ধরনের শ্রোতার প্রিয় শিল্পী তো বটেই, সবার কাছে তিনি সুরের দেবী। তিনি মুম্বাই থাকেন, জানতাম, তাই এত কাছে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হলো এ যাত্রায়। তাই যাওয়ার সময় তাঁর জন্য একটা সাদা জামদানি কিনে স্যুটকেসে নিয়ে নিলাম। যা–ই হোক, বিমান যখন মুম্বাইয়ের আকাশে ভাসছে, তখন প্রথমেই মনে হলো আমি লতাজির দেশে এসেছি।
যা–ই হোক, আমার বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং ভালোভাবেই শেষ হলো। এর প্রযোজক জেনি পিন্টো আমাকে বললেন, কাজটি খুব দারুণ হয়েছে। চলুন, আপনাকে শপিংয়ে নিয়ে যাই। আমি তখন বললাম, দিদি, আমি শপিং করতে চাই না। আমি একবার লতাজির দর্শন পেতে চাই। আমার স্বপ্নটা পূরণ করে দিন।
তিনি তখন বললেন, ‘ও লতাজি, তিনি তো আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ। কোনো সমস্যা নেই। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
পরদিনই মেহবুব স্টুডিওতে লতাজির একটা ছবির গানের রেকর্ডিং ছিল। জেনি পিন্টো একটা ফুলের বুকি আর সঙ্গে একজন আলোকচিত্রী আমার সঙ্গে দিয়ে দিলেন। যথাসময়ে মেহবুব স্টুডিওতে গেলাম। স্টুডিওতে ঢুকেই আমার হাত–পা ঠান্ডা বরফশীতল হয়ে গেল। দেখলাম লতাজি ট্র্র্যাকের ওপর গাইছেন ‘মেরে লিয়ে চুড়িয়া খানকে’ গানটি। স্টুডিওতে বসে আছেন আরও বিখ্যাত কয়েকজন। আমি তাঁদের নামে চিনি, কিন্তু দেখিনি কখনো। পরে জানলাম ইয়াশ রাজ প্রযোজক, (পরিচালক) ও শিব কুমার শর্মা (বিখ্যাত সন্তর শিল্পী)। লতাজি গানটি স্বচ্ছন্দে গাইতে পারছিলেন না। বারবার গাইতে গিয়ে থেমে যাচ্ছিলেন, আর বলছিলেন, কোথাও কোনো সমস্যা আছে, মিউজিক ট্র্যাকে। তখন চেক করে দেখা গেল তবলাটা সুরে বাজেনি। রেকর্ডিং ক্যানসেল হয়ে গেল। লতাজি বললেন তবলাশিল্পীকে ডেকে আবার বাজিয়ে নিতে। তারপর তিনি গাইবেন। এরপর লতাজিকে বলা হলো বাংলাদেশ থেকে একজন দেখা করতে এসেছেন।
আমি বলে দিয়েছিলাম, একজন শিল্পী হিসেবে নয়, আমার পরিচয় যেন একজন মডেল হিসেবে দেওয়া হয়। লতাজি এলেন। পরনে সাদা ফিনফিনে শিপন শাড়ি। টিকটিকে দুটো চিকন বেণি হাঁটু পর্যন্ত নেমে গেছে।
আমি তো সাক্ষাৎ সুরের দেবীকে সামনাসামনি দেখে জ্ঞান হারানোর অবস্থা। তাঁর পায়ে পড়ে গেলাম। আর উঠি না। কাঁদতে কাঁদতে শেষ। তিনি আমাকে টেনে তুললেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘কান্না থামাও, এত ইমোশনাল হতে নেই। এসো, পাশে বসো।’ কিন্তু আমি সোফায় বসি না। হাঁটু গেড়ে ফ্লোরেই বসে পড়ি আবার। তিনি বললেন, নিচে বসতে নেই। সোফায় পাশে বসালেন। আমার হাত ধরে রইলেন। আমিও আর হাত ছাড়ি না। এরপর বললেন, তিনি বাংলাদেশের সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলীকে চেনেন। আর রুনা লায়লার কথা বললেন। কথায় কথায় বললেন, ‘কে যেন বলল, তুমি গানও করো।’ গান করতে বললেন। কিন্তু আমি বললাম, ‘আপনার সামনে গান করতে আমি মোটেও পারব না।’
লতাজি বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা পোষণ করলেন। বললেন, যদি কখনো আমি বাংলাদেশে যাই, দেখা করবে তো?
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে বললেন, আমাদের বাংলাদেশের ঠিকানা, ফোন নম্বর রেখে দিতে। আমি লতাজিকে সামনে পেয়ে সব ভুলে গেলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে আসা আলোকচিত্রী (নামটা মনে পড়ছে না) বললেন, দিদি, লতা দেবীর জন্য যে শাড়ি এনেছেন, সেটা দেবেন না। আমি তাড়াতাড়ি সেই শাড়িটি তাঁকে দিলাম। তিনি ভীষণ খুশি হলেন। বললেন, ‘এখানেই খোলো। সবাই দেখুক কী এনেছ, তুমি আমার জন্য।’ প্যাকেট খুলতেই লতাজি বললেন, ‘বাঙাল কা জামদানি!’
এত বিনয়ী, এত সাধারণ একজন মানুষ লতা মঙ্গেশকর, আমি আমার জীবনে আর দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাইনি। তাঁর সঙ্গে দেখা করার পর হোটেলে ফিরে আমি দুই দিন সেই হাত আর ধুইনি, যে হাত তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে রেখেছিলেন। এর অনেক বছর পর ২০১০ সালে আবার সুযোগ এসেছিল, বেসরকারি চ্যানেল এনটিভির জন্য তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেবেন। আমি যেহেতু হিন্দি, উর্দু বলতে পারি, তাই এনটিভির অনুষ্ঠান প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ আমাকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ঠিক করেন। তিনি প্রশ্নপত্রও ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমরা সেই ইন্টারভিউ নিতে মুম্বাই যাই। সঙ্গে এনায়েতুর রহিম। হোটেল ম্যারিয়টস এ উঠেছিলাম। সবকিছু তৈরি। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা আগে জানা গেল তিনি ভীষণ অসুস্থ। শুটিং বাতিল হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার আর তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হলো না।
আমি লতাজির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।