২৬ বছরের অভিনয়জীবন তানভীন সুইটির। এখনো মনের মতো কাজ করা হয়নি। সেই অতৃপ্তি মেটাতে এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ বেতারের নাটকে অভিনয় করেছেন। পাঁচ বছর পর করেছেন উপস্থাপনা। চলছে ধারাবাহিক ও খণ্ড নাটকের কাজ। নিয়মিত অনুশীলন করছেন মঞ্চ নাটকের। ব্যক্তিজীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
প্রথমবারের মতো জাহিদ হাসানের পরিচালনায় অভিনয় করছেন। অভিজ্ঞতা কেমন?
অনেক নাটকে জাহিদ হাসানের সঙ্গে অভিনয় করেছি। এবারই প্রথম তাঁর পরিচালনায় ‘পিছুটান’ ধারাবাহিকে অভিনয় করছি। তাঁর মুখে গল্প শুনেই ভালো লেগেছিল। অভিনয় করেও প্রশংসা পাচ্ছি। নির্মাতা জাহিদ ভাই ভালো, তবে আমার কাছে তিনি অভিনেতা হিসেবে সেরা।
অভিনয়ে আপনার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। এখনকার নাটকে কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে পান?
আগে নাটকের কেন্দ্রে পরিবার থাকত। সেই পরিবারকে ঘিরেই একটা গল্প তৈরি হতো। এখন গল্পে তিন চরিত্র—আমি, তুমি ও সে। আমাদের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হবে। কিন্তু পরিবারবিহীন সংস্কৃতি আমাদের কখনোই হবে না। গুটিকয় তরুণ দর্শক হয়তো সেই নাটকগুলো পছন্দ করছেন। কিন্তু দর্শকের একটি বড় অংশ পারিবারিক গল্পের নাটক দেখতে পারছেন না।
এখানে কি শিল্পীর কোনো দায় আছে?
দর্শকের জন্যই আমরা কাজ করি। তাঁদের জন্য আজ আমরা অভিনয়শিল্পী। সেই জায়গা থেকে নির্মাতার পাশাপাশি অভিনয়শিল্পীরও অবশ্যই দায় আছে। অনেকেই মনে করেন, একটি কাজ করলেই হয়ে গেল। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে, আমরা আসলে দর্শককে কী দিচ্ছি, এ বিষয়ে ভাবা উচিত। শিল্পীরা একটু সচেষ্ট হলেই সামাজিক অবক্ষয় রোধে নাটক ভূমিকা রাখতে পারে।
কয়েক বছর ধরে নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে ইউটিউবে ‘ভিউ’কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে আপনার মতামত কী?
একসময় দক্ষ অভিনয়শিল্পীরা গল্প ও চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে অভিনয় করতেন। এখন নাটক নির্মাণের মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘ভিউ’। যাঁদের টিকটক, ইউটিউবে ভিউ বেশি, ফেসবুকে লাইক বেশি, তাঁদের ভালো অভিনয়শিল্পী হিসেবে ধরার একটা প্রচলন শুরু হয়েছে। তাঁরাই কাজ পাচ্ছেন। আর এতে কিছু মানুষ ভিউ ভিউ করে শিল্পটাকে নষ্টের পাঁয়তারা করছেন।
নিশ্চয়ই এখনকার নাটক সম্পর্কে চেনা পরিচিতজন ও দর্শকের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পান। তা কেমন?
আগে নাটক প্রচারের পর দেশ-বিদেশের মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা শুনতাম। এখন বেশির ভাগ মানুষই বলেন, তাঁরা পরিবার নিয়ে নাটক দেখতে পারেন না। এখনকার নাটকের অনেক দৃশ্য দেখে তাঁদের লজ্জা লাগে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, চিত্রনাট্যকার, নির্মাতাদের বলব আপনারা ‘ভিউ’কে গুরুত্ব না দিয়ে নাট্যশিল্পকে বাঁচান। অভিনয় জানা শিল্পীদের কাজে লাগান।
তরুণদের মাঝে অভিনয় শেখার আগ্রহ কতটা দেখতে পান?
বর্তমান সময়ে যারা অভিনয় করে, তাদের সঙ্গে আমি কাজ করিনি। যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের মধ্যে একমাত্র অপূর্ব আছে। অপূর্বর প্রথম নাটক আমার সঙ্গে করা। তার মধ্যে শেখার প্রচেষ্টা ছিল। আফরান নিশোর নাটক সবাই দেখছে, তার অভিনয় মেধা ভালো লেগেছিল। সে–ও শিখতে চাইত। মেহজাবীনের অভিনয়ও ভালো লাগে, লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় যখন অংশগ্রহণ করেছিল, তখন বাংলা খুব একটা বলতে পারত না। তখন ওকে বলেছিলাম, তোমার চেহারা সুন্দর, বাংলা শিখে যদি অভিনয়ে আসো, তাহলে ভালো করবে। সে এখন নাটকে সুন্দর বাংলা বলে, দারুণ সব চরিত্রে অভিনয় করে। তরুণদের প্রচুর শিখতে হবে। এখন যারা ভিউ দেখে নাটকে সুযোগ পাচ্ছে। তাদের বলব, থিয়েটার না করলেও শিখতে থাকো, নইলে টিকে থাকা কষ্ট হবে।
এখনকার অভিনয়শিল্পীর অনেকে ঢাকার বাইরে গিয়ে অভিনয় করতে চান না। অনেকে আবার গল্প দেখে শুটিং করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এই রকম কিছুর মুখোমুখি হয়েছেন?
এই ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি জানতাম না। গতকাল বুধবার একজনের কাছে প্রথম শুনলাম, দুজন অভিনয়শিল্পী ঢাকার বাইরে গিয়ে শুটিং করতে পারবেন না। শুনে তো আমি অবাক। আমাদের সময়ে শুটিংয়ের জন্য সবাই দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াতাম। কাদা, বৃষ্টি গায়ে মেখে দিনের পর দিন শুটিং করেছি। এখন তো আবার এমনও শুনি, ছেঁড়া কাপড় বা বস্তির মধ্যে গিয়ে অনেকেই শুটিং করেন না। আমরা সব সময় মনে করতাম, লোকেশন থেকে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলব। কিছু নাটকের গল্প দেখে মনে হয়, আমরা এখন বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। আরও কত কী যে শুনি।
আর কী শুনেছেন?
এখন নাকি অনেক অভিনেতা ইচ্ছেমতো শুটিং করেন। শুটিং প্যাকআপ করে দেন। একজন শিল্পীর এই আচরণ মোটেও ঠিক না। তাঁর একবার ভাবা উচিত, একটা কাজের সঙ্গে কত মানুষের রুটিরুজি জড়িত। এমনও হতে পারে, একজন কাজ করে বাসায় চাল কিনে নিয়ে যাবেন। তাহলে তাঁদের কী হবে। শিল্পীর কাজ শুধু অভিনয় না। তাঁকে আরও অনেক কিছু ভাবতে হয়। তাঁদের দায়বদ্ধতা অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি।
২৬ বছরের অভিনয়জীবনে কোনো আফসোস আছে?
অভিনয়জীবন নিয়ে অনেক আফসোস আছে। ১০ বছর আগে বুঝলে হয়তো আরেকটু এগোতে পারতাম। অনেক ভালো নাটকে কাজ করতে পারতাম। তবে আমি অনেক ভালো নাটক ও গুণী শিল্পীদের সঙ্গে টিভি ও মঞ্চে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছি। অনেক কিছুই পেয়েছি। আফসোস এটাই, সব শিল্পীদের মতো আমিও, মনের মতো ভালো একটি চরিত্রের অপেক্ষায় আছি। সেই কাজটার অতৃপ্তি রয়ে গেছে।
আপনাকে আগের মতো অভিনয়ে দেখা যায় না কেন?
আমি তো নিয়মিত অভিনয় করি। ধারাবাহিক, খণ্ড নাটকে করছি, আবার নিয়মিত উপস্থাপনা শুরু করলাম। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ বেতারের নাটকে অভিনয় করলাম। মহামারির সময় বড় তিনটা বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করলাম। একটা ছবিতে অভিনয় করেছি। থিয়েটারের নতুন নাটকে অনুশীলন করছি। তবে আগের চেয়ে পর্দায় কম দেখা যায়। আগে দশটা নাটকে কাজ করলে এখন তিনটাতে করি। তা ছাড়া এখন দর্শকেরাও নাটক দেখেন কম। অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত আছি। আমি মূলত প্রচারবিমুখ মানুষ। নিজেকে সব সময় আড়ালে রাখতে চাইতাম। তবে এখন নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন এনেছি।
কী ধরনের পরিবর্তন?
আগে আমি অনেক বেশি চুপচাপ ছিলাম। আমাকে কারণে–অকারণে কেউ কিছু বললে চুপচাপ থাকতাম। এখন আমি পাল্টা জবাব দিই। কথার উত্তর না দিলে মানুষ লাথি দেওয়ার সুযোগ পায়। এর ফলে কেউ লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুযোগ পায় না। নইলে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফুটবলের মতো খেলতে থাকবে।
অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতি করছেন, জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা আছে?
বিনোদন অঙ্গনে আমি যত দিন ধরে কাজ করছি, তত দিন ধরে সবার পাশে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এবারও মহামারির সময় লাইটম্যান, মেকআপম্যান ও অনেক শিল্পীর পাশে থাকার চেষ্টা ছিল। যদিও এসব ছিল ছোট পরিসরে। এখন আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চাই। সবার প্রশ্ন আপনি নির্বাচন করবেন? আমি তাঁদের বলি, যোগ্যতা থাকলে আমি এমপি হব। এখানে তো নাটকের ভিউ দেখে নির্বাচনে ডাকবে না। সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলার যোগ্যতা থাকতে হবে। তবে আমি এমপি হওয়া ছাড়াও সারাক্ষণ মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমার চেষ্টা থাকবে আমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর।