টিভি নাটকের ‘ভিউ’ সংস্কৃতি নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছে। কিছুদিন আগে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসই দেন পরিচালক শিহাব শাহীন। ওই পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই ঈদে চ্যানেল, প্রডিউসার সবার এক কথা—ভিউ চাই, ভিউ।’ তাঁর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন আরও বেশ কিছু নির্মাতা। তাঁদের অনেকে বলছেন, বাণিজ্যিক কারণে নাটকের বেশি ভিউ অবশ্যই দরকার আছে। তবে সেই ভিউ কী ধরনের কাজ দিয়ে হবে, এটাই মুখ্য। কারও কারও অভিযোগ, কিছু ইউটিউব ও টেলিভিশন চ্যানেল ভিউয়ের প্রতিযোগিতায় নেমে নাটকের মানকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এতে নাটক শিল্পের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। কোনো পরিচালক বলছেন, ভিউয়ের প্রতিযোগিতা পরিচালকদের মানসিক সংকটে ফেলছে। কাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার পথে। এ ছাড়া ভিউ নিয়ে নতুন সংকটের কথা বললেন এই সময়ের কয়েকজন পরিচালকেরা।
কাজ শুরুর আগেই ভিউয়ের চাপ দিলে নির্মাতা হিসেবে কাজের স্বাধীনতা থাকে না বলে মনে করেন শিহাব শাহীন। তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। দর্শকদের আবেগ, চাওয়া মাথায় নিয়ে কাজ করা বাড়তি চাপ। ভিউ বাড়ানো কনটেন্ট চাই বললেই ব্যাপক দর্শকদের জন্য কনটেন্ট বানাতে হয়। তখন মোটাদাগে বেশির ভাগ দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রাখতে হয়। এই বিরাট দর্শকগোষ্ঠীর বড় অংশ শৈল্পিক কাজ সেভাবে পছন্দ করে না। এটাই বাস্তবতা, বাধ্যবাধকতাও বটে। শিল্পটা এখন কম হচ্ছে।’
ভিউ নিয়ে স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আগের চেয়ে ভিউ নিয়ে এবার একটু বেশি কথা শুনছি। গত বছর ঈদুল আজহায় বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে। সেগুলো হয়তো তেমন একটা দেখেনি দর্শক। সেই অভিজ্ঞতা হয়তো টেলিভিশন বা ইউটিউব প্রযোজকদের মাথায় কাজ করছে। যে কারণে নাটকগুলো যেন দর্শকপ্রিয় হয়, সে জন্য বাধ্য হয়ে কিছুটা চাপ দিচ্ছেন। দর্শক না দেখলে তো আবার টিভি কনটেন্ট টিকিয়ে রাখাই হবে কষ্টকর।’
এখনো সবচেয়ে বেশি ভিউ পাওয়া নাটক ২০১৭ সালে প্রচার হওয়া ‘বড় ছেলে’। নাটকটির পরিচালক মিজানুর রহমান আরিয়ানের ঝুলিতে আছে একাধিক কোটি ভিউয়ের নাটক। এই নির্মাতা বলেন, ‘ভালো কনটেন্ট এখনো জনপ্রিয় হতে পারে, আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী। জনপ্রিয়তারও মানদণ্ড হয়ে গেছে ভিউ। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করি, তারা জানে আমি ভালো কনটেন্ট বানাব। সেটা ভিউ হলে ভালো। আমি সব সময় দর্শকদের পছন্দের কনটেন্ট বানানোর চেষ্টা করি।’
‘ভিউ সংস্কৃতি’ নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা গেল আরও এক তথ্য—এখন তরুণ নির্মাতাদের কাজ পাওয়ার মানদণ্ডও নির্ধারিত হচ্ছে ভিউ দিয়ে। হিসাবটা দুই বছর আগেও ছিল আলাদা। তখন একজন নির্মাতার নাটকের ভিউ ২০ লাখ হলেই তারকাদের শিডিউল পাওয়ার ‘যোগ্য’ হতেন। এই মিলিয়ন ভিউয়ের হিসাব এখনো আছে। তবে তাঁর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কত দিনে নাটক মিলিয়ন ভিউয়ের রেকর্ড ছুঁয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিন তরুণ নির্মাতা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মিলিয়ন ভিউ না হলে সেই নির্মাতাকে সময়ের ১০ থেকে ১৫ জন অভিনয়শিল্পী শিডিউলই দেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্মাতা বলেন, ‘শিডিউল চাইতে গেলে আগে তারকারা জিজ্ঞেস করেন, নাটকের ভিউ কত। দুই মিলিয়ন ভিউ না হলে কোনো শিল্পী কথা বলার সময়ই দেবেন না। এবার ঈদেও একই অবস্থা। এ জন্য নির্মাতারা ভিউ-মুখী। শিল্পচর্চার দিন শেষ। খেয়েপরে বেঁচে থাকতে তো হবে।’
এই প্রসঙ্গে শিহাব শাহীন বললেন, ‘তরুণ নির্মাতাদের সব সময় একটা চাপ ছিলই। প্রথম থেকেই নির্মাতাদের ভাবতে হয়, দর্শকপ্রিয় কিছু বানিয়েই টিকে থাকতে হবে। তরুণেরা এখন দর্শক ভিউ দিয়ে অবস্থান পাকাপোক্ত করছেন।’
তবে এই ‘ভিউ সংস্কৃতি’র মধ্যেও পরিচালকদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিলেন পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু। তিনি মনে করেন, পরিচালক একজন শিল্পী। কাজ দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। ছোট পর্দার পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি লাভলু বলেন, ‘ইউটিউব–টেলিভিশনের ভিউ বাড়ানোর জন্য আমি নাটক বানাব নাকি বানাব না, সেটা পরিচালককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে, আমি শিল্প সৃষ্টি করতে এসেছি। কাজের ক্ষেত্রে ইউটিউব একটি আলাদা জায়গা। সেখানে একটি কাজ কেমন হবে, তার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় নির্মাতার রুচিবোধ। আমাকে যদি কেউ বলেন, ভিউ বাড়াতে নাটকে স্ল্যাং ভাষা ব্যবহার করেন, সেটা আমি কখনোই করব না। কারণ, আমি চাই না নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক।’