বাংলা চলচ্চিত্রের সৌভাগ্য, সৌমিত্রকে নিজের মধ্যে পেয়েছিল

শিল্পী হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যাত্রা শুরু করেছিলেন অভিনয় দিয়ে।ছবি: সংগৃহীত

মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই? তা কী করে হয়? হয়, যদি মানুষটা হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। টানা ৪১ দিন তিনি লড়াই করলেন। রোগে পর্যুদস্ত শরীর নিয়ে করোনাকে হারিয়ে উঠেও দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। শরীরে মারণরোগ ক্যানসারের ধকল, তার সঙ্গে যুক্ত হলো করোনার ধকল। অবশেষে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন দুই বাংলার প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নিজের শহর কলকাতায় শেষনিশ্বাস ফেললেন তিনি।

১৫ নভেম্বর রোববার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসানের ঘোষণা দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
ছবি: কোলাজ

গতকাল রোববার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসানের ঘোষণা দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তাঁর প্রয়াণের খবরের শোক পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে এর ছায়া পড়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অনুরাগীদের মধ্যেও। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীসহ ঢাকা, কলকাতা ও মুম্বাইয়ের অভিনয়শিল্পীরা।
সৌমিত্র চলে যাবেন, শনিবার সেটা যেন ধরেই নিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। মেডিকেল বুলেটিনে জানানো হয়েছিল, পরিস্থিতি বেশ সংকটজনক। কেননা শেষ ২৪ ঘণ্টায় তাঁর কোনো উন্নতি হয়নি। কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমের চিকিৎসকেরা

জানিয়েছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ৪০ দিন ধরে যুদ্ধ করেও তিনি স্থিতিশীল নন, দৈব কিছুর প্রয়োজন। তেমন দৈব কিছু আর ঘটেনি।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় সৌমিত্রর জন্ম। তবে পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার গড়াইতীরের কয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। বাবা নাটকের দলে অভিনয় করতেন, পারিবারিক সূত্রে ছেলেবেলাতেই নাটকে সৌমিত্রর অভিনয়ে অভিষেক।

১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় সৌমিত্রর জন্ম।
ছবি: কোলাজ

কলকাতা সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা শেষে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই স্নাতকোত্তর। কলেজের শেষ বর্ষে মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখার অভিজ্ঞতা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় তাঁর। শিশির ভাদুড়ীকেই গুরু মানতেন সৌমিত্র। একসময় পরিচয় হয় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। বাংলা চলচ্চিত্রে সেই এক কিংবদন্তির জন্মলগ্ন। সত্যজিতের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের হাতেখড়ি হয় সৌমিত্রর। ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অপু হন তিনি। ৬ ফুট লম্বা, ছিপছিপে চেহারার নাটকপাগল তরুণকে নিজের অপু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘অপুর সংসার’। প্রথম ছবিতেই সহজ অভিনয়ের সৌন্দর্যে উঠে আসেন আলোচনায়। সত্যজিতের হাত ধরে কেবল বাংলা বা ভারতীয় চলচ্চিত্র নয়, বিশ্ব–চলচ্চিত্র পায় নতুন এক শিল্পীকে।

কলকাতা সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা শেষে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছবি: সংগৃহীত

সত্যজিৎ পরিচালিত তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘দেবী’তেও অভিনয় করলেন সৌমিত্র। বিপরীতে প্রথম ছবির নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। একই বছর তপন সিনহার পরিচালনায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে অভিনয়। পরের বছর আবার সত্যজিতের ছবিতে। এবার তাঁর তিন কন্যা চলচ্চিত্র ত্রয়ীর সমাপ্তিতে অপর্ণা সেনের বিপরীতে সৌমিত্র। সে এক ভিন্ন সৌমিত্র। পরিচালক সত্যজিৎ রায় আর অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্রের এক অমর যুগলবন্দী।

সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র।
ছবি: সংগৃহীত

সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র। তার মধ্যে আছে সৌমিত্রর উল্লেখযোগ্য ছবি ‘অভিযান’, ‘অশনি সংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘গণশত্রু’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ইত্যাদি। সত্যজিতের সাহিত্যসৃষ্টি ফেলুদাকে বড় পর্দায় জীবন্ত করেছিলেন তিনিই। ছোট ও বড় পর্দায় পরবর্তী সময়ে ফেলুদার নানা রূপায়ণ করেছেন আরও বহু অভিনেতা; কিন্তু সৌমিত্রর ফেলুদা হয়ে আছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

মঞ্চে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ছবি: প্রথম আলো

সত্যজিৎ রায়ের ছবি ছাড়াও তাঁর অভিনীত আলোচিত ছবির মধ্যে আছে ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘গণদেবতা’, ‘দেবদাস’, ‘নৌকাডুবি’, ‘অসুখ’, ‘ময়ূরাক্ষী’ ও ‘প্রাক্তন’। অভিনয় করেছেন মৃণাল সেনের পরিচালনায় ‘পুনশ্চ’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’, অনীক দত্তর পরিচালনায় বরুণবাবুর বন্ধুসহ ৬১ বছরের দীর্ঘ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে প্রায় ৩০০টি ছবিতে।

শেষ যাত্রায় বাবার কপালে হাত রাখছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে পৌলমী বসু। কলকাতা, ১৫ নভেম্বর
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পয়লা অক্টোবর থেকে শরীর ভালো যাচ্ছিল না সৌমিত্রর। প্রথমে জ্বর। করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না। পরে করোনার নমুনা পরীক্ষায় কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। ৬ অক্টোবর তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখানে সর্বশেষ ১৪ অক্টোবর করোনার নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, তিনি সেরে উঠেছেন। এরপর তিনি সুস্থ হতে থাকেন। তবে চিকিৎসা চলছিল। ২৪ অক্টোবর রাত থেকে আবার তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি চেতনাহীন হয়ে পড়েন। প্লাজমা থেরাপি, শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার, মিউজিক থেরাপিসহ নানাভাবে এই অভিনেতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা, কিন্তু সব বিফলে চলে যায়।

শিল্পী হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যাত্রা শুরু করেছিলেন অভিনয় দিয়ে।
ছবি: ফেসবুক থেকে

রোববার সন্ধ্যায় কলকাতার কেওড়াতলা শ্মশানে রাজ্য সরকারের শ্রদ্ধার পর সৌমিত্রর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। দুপুরে হাসপাতাল থেকে শুরুতে তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় গলফ গ্রিনের বাড়িতে, সেখান থেকে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও এবং পরে রবীন্দ্রসদনে। সেখান থেকে তাঁর মরদেহ সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলায়।
শিল্পী হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যাত্রা শুরু করেছিলেন অভিনয় দিয়ে। সেটি ছিল সূচনা মাত্র। অভিনয়ের বাইরে ভিন্ন শিল্পের জগতেও পা রেখেছিলেন সার্থকতার সঙ্গে। কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন গদ্য।

নির্মাল্য আচার্য্যের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলেন নন্দিত সাহিত্যপত্র ‘এক্ষণ’। নিয়মিত এ পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকে দিতেন সত্যজিৎ রায়। মগ্ন হয়েছিলেন আবৃত্তিতে, রবীন্দ্রপাঠে, নাট্যসংগঠনে। জীবনের শেষ পর্বে ঝুঁকে পড়েছিলেন ছবি আঁকায়।

৬১ বছরের দীর্ঘ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে প্রায় ৩০০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত

অপু, উদয়ন পণ্ডিত, ফেলুদা, অশোক গুপ্ত থেকে কিং লিয়ার—বাংলা চলচ্চিত্রে, নাটকে অভিনয় করে তিনি হয়ে ওঠেন অভিনয়ের কিংবদন্তি। নিজে পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা ‘লিজিয়ন অব অনার’। ২০০৪ সালে তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করা হয়। এ ছাড়া পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে, বঙ্গভূষণসহ ভারতের জাতীয় স্তরের একাধিক পুরস্কার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে সাম্মানিক ডি-লিট দিয়েছে কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলা চলচ্চিত্রের বড় সৌভাগ্য, বিশ্বের সেরা একজন অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সে নিজের মধ্যে পেয়েছিল।
ছবি: সংগৃহীত

পড়ন্তবেলায় প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জীবনের এ পর্যায়ে এসে কোনো আক্ষেপ আছে কি না, জানতে চাইলে সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ এ জন্য নেই যে অনিবার্যকে মেনে নেওয়াই তো সভ্যতা। বরং আমি মনে করি, আজ যে বৃদ্ধ হয়েছি, তারও একটা ভয়ংকর ভালো দিক আছে। এখন বুঝতে পারি, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে, আর দেশের মানুষ আমাকে যে ভালোবাসে, তা শুধু আমার অভিনয়ের জন্য। বাঙালি আমাকে মনে করে আমি তাদের “ন্যাশনাল প্রাইড”। এটা তো কম পাওয়া নয়, বরং বলতে পারেন এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
বাংলা চলচ্চিত্রের বড় সৌভাগ্য, বিশ্বের সেরা একজন অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সে নিজের মধ্যে পেয়েছিল।

অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন