কোভিড-১৯ অনেকটা গ্রিক পুরাণের বহু আনন দানব হাইড্রার মতো, তাকে দমন করা যেন সহজ কর্ম নয়, এমনকি এক বছর পরও। পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে তিন দিক দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে এই রোগ: রোগ, রোগ দমনের ব্যবস্থার অর্থনৈতিক প্রভাব ও সংকটের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব। তবে দীর্ঘ মেয়াদে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা যতটা ভাইরাসের ওপর নির্ভর করছে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করছে সরকারি নীতির ওপর।
নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে ২০২০ সালে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের কম হতে পারে—১৯৬৭ সালের পর সর্বনিম্ন। ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছর। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি গত বছর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনিশ্চয়তার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণের কারণে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি তা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায়ও প্রভাব ফেলবে। অসুস্থতা, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা, চাকরি হারানো, বিদ্যালয় বন্ধ থাকা—এসব কিছুই মানবসম্পদ গঠনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
কোভিডের ধাক্কায় গত বছর বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কথা হচ্ছে, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আগামী এক দশকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর ১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। এতে যে গরিব মানুষেরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের না আছে শিক্ষার সুবন্দোবস্ত, না আছে চিকিৎসা ও অর্থায়ন প্রাপ্তির সুযোগ।
তবে এসব কিছু চিরস্থায়ী নয়। রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার পরিণতিতে আগামী দিনে কী ঘটবে, তা যদি আগেভাগে জানা যায়, তাহলে সরকারের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব। সে জন্য বেশ কিছু অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা যেতে পারে। প্রথমত, আক্রান্তদের চিহ্নিত ও বিচ্ছিন্নকরণ শুধু টিকা আসা পর্যন্তই জরুরি নয়, টিকাদান শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা চালিয়ে যেতে হবে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, পরীক্ষাভিত্তিক কৌশল নেওয়া হলে টিকাদানের কার্যকারিতা অনেকটাই বেড়ে যায়। ন্যায্যতার সঙ্গে টিকা বিতরণ করা হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াই কেবল ত্বরান্বিত হবে না, সামাজিক স্থিতিশীলতাও আসবে।
রাজস্ব খাতে সংস্কার আনা জরুরি হয়ে গেছে। সেটা হলে সরকারের পক্ষে কেবল ত্রাণকার্যে বড় ব্যয় করা সম্ভব হবে তা-ই নয়, বিনিয়োগ বাড়ানোও সম্ভব। কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে না। এই অঞ্চলের সরকারগুলো সামগ্রিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের ১৮ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করতে পারে, উদীয়মান অন্যান্য বাজারের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম। কর ভিত্তি বৃদ্ধিও পাশাপাশি অনুক্রমিক করারোপ করতে হবে এবং জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেওয়া চলবে না—অনেক দেশেই যা জিডিপির ২ শতাংশ। এতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই হতে পারে।
সামাজিক সুরক্ষা অনেক দেশেই আছে, তবে যথাযথ নয়। এই কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি কঠিন হয়ে পড়েছে। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হলে কাজে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মালয়েশিয়ার কথা বলা যেতে পারে—সর্বজনীন জাতীয় পরিচয়পত্র, বিস্তৃত মোবাইল ফোন সেবা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কারণে দেশটিতে দ্রুত এক কোটি মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্র মানুষেরা যেন ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির আওতায় চলে আসেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তির অভাবনীয় ব্যবহার আমরা মহামারির সময় দেখেছি। এতে যেমন মানুষ সশরীর বাজারে না গিয়ে সদাই করতে পেরেছেন, তেমনি বিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও অনেক শিশুর শিক্ষণ বন্ধ হয়নি, যাদের সেই সামর্থ্য আছে। সে জন্য প্রযুক্তির ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই করতে হবে। অর্থনীতি যেন আরও ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গত এক দশকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জ্বালানি চাহিদা মিটিয়েছে। পরিণাম, পরিবেশদূষণ। কিন্তু দূষণবিহীন জ্বালানি ও সামুদ্রিক সম্পদে বিনিয়োগ করা আগামী দিনের জন্য অনেক বেশি জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা আগামী দিনে আরও জরুরি হয়ে উঠবে। দূষণবিহীন জ্বালানিতে বিনিয়োগে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।
তবে এই অঞ্চল দ্রুতই কোভিড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে। সম্ভবত পূর্ব এশিয়া সবার আগে এই সংকট কাটিয়ে উঠবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের পরিকল্পনা ও নীতির ওপর। সরকার সঠিক পথে এগোলে এই চ্যালেঞ্জও সুযোগে পরিণত হতে পারে।
লেখক: বিশ্ব ব্যাংকের পূর্ব ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন