ঋণং কৃত্বা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কারও ধার ধারি না, এমন কথা আর যে-ই বলুক, আমি কখনোই বলতে পারি না। আমার ধারণা, এক কাবুলিওয়ালা ছাড়া এ কথা এ জগতে কেউই বলতে পারে না। অমৃতের পথ ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা’; অকালে মৃত হতে না হলে ধার করতেই হবে।

ধার হলেও কথা ছিল বরং, কিন্তু তা-ও নয়। বাড়িভাড়া বাকি, তা-ও বেশি না, পাঁচ শ টাকা মাত্তর! কিন্তু তার জন্যই বাড়িওয়ালা করাল মূর্তি ধরে দেখা দিলেন এক দিন—

‘আপনাকে অনেক সময় দিয়েছি আর আমি দিতে পারব না। কোনো অজুহাত শুনছি না আর—’

‘ভেবে দেখুন একবার,’ আমি তাঁকে বলতে যাই: ‘সামান্য পাঁচ শ টাকার জন্য আপনি এমন করছেন! অথচ এক যুগ পরে এক দিন—আমি মারা যাবার পরেই অবিশ্যি—আপনার এই বাড়ির দিকে লোকে আঙুল দেখিয়ে বলবে, একদা এখানে বিখ্যাত লেখক শ্রীঅমুকচন্দ্র অমুক বাস করতেন।’

‘বাস করতেন! বাস করতেন!! বাস করে আমার মাথা কিনতেন!’ জবাবে তাঁর দিক থেকে যেন একটা ঝাপটা এল—‘শুনুন মশাই, আপনাকে সাফ কথা বলি, যদি আজ রাত্তির বারোটার ভেতর আমার টাকা না পাই, তাহলে এক যুগ পরে নয়, কালকেই লোকে এই কথা বলবে।’

বাড়িওয়ালা তো বলে খালাস, চলে গেলেন। কিন্তু এই একবেলার মধ্যে এত টাকা আমি পাই কোথায়? পাছে ধার দিতে হয়, সেই ভয়ে সহজে কেউ আমার মতো লেখকের ধার ঘেঁষে না। লেখক মাত্রই ধারালো, আমি আবার তার ওপরে এক কাঠি—জানে সবাই।

হর্ষবর্ধনের কাছে যাব? তাদের কাছে এই কটা টাকা কিছুই না। তাদের কীর্তিকাহিনি লিখে অনেক টাকা পিটেছি, এখন তাদের পিঠেই যদি চাপি গিয়ে? তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় যদি এই দায় থেকে উদ্ধার পাই?

কথাটা গিয়ে পাড়তেই হর্ষবর্ধন বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়! আপনাকে দেব না তো কাকে দেব!’

চমকে গেলাম আমি। কথাটা যেন কেমনতরো শোনাল না?

‘আপনি এমন কিছু আমাদের বন্ধু নন?’ তিনি বলতে থাকেন।

‘বন্ধুত্বের কথা যদি বলেন—’ আমি বাধা দিয়ে বলতে যাই।

‘হ্যাঁ, বন্ধুত্বের কথাই বলছি। আপনি তো আমাদের বন্ধু নন। বন্ধুকেই টাকা ধার দিতে নেই, মানা আছে। কেননা, তাতে টাকাও যায়, বন্ধুত্বও যায়।’ তিনি জানান, ‘তবে হ্যাঁ, এমন যদি সে বন্ধু হয় যে বিদেয় হলেই বাঁচি, তার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাকে ওই ধার দেওয়া। তাহলেই চিরকালের মতন নিস্তার।’

আহা! আমি যদি ওঁর সেই দ্বিতীয় শ্রেণির বন্ধু হতাম—মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি।

টাকাটা আমার দরকার পড়েছে আবার। ওই পাঁচ শ টাকাই। সে জন্যই তোমার কাছে এলাম ভাই! এই শনিবারই তোমায় আবার ফিরিয়ে দেব টাকাটা। নির্ঘাত।

‘কিন্তু আপনি তো বন্ধু নন, লেখক মানুষ। লেখকেরা তো কখনো কারও বন্ধু হন না।’

‘লেখকদেরও কেউ বোধ হয় বন্ধু হয় না।’ সখেদে বলি।

‘বিলকুল নির্ঝঞ্ঝাট! এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে বলুন?’ তিনি বলেন, ‘আপনি যখন আমাদের আত্মীয়-বন্ধু কেউ নন, নিতান্তই একজন লেখক, তখন আপনাকে টাকা দিতে বাধা কী আর? কত টাকা দিতে হবে বলুন?’

‘বেশি নয়, শ পাঁচেক। আর একেবারে দিয়ে দিতেও আমি বলছি না।’ আমি বলি, ‘আজ তো বুধবার। শনিবার দিন টাকাটা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেব।’

কথা দিলাম। এ ছাড়া আজ বাড়িওয়ালার হাত থেকে ত্রাণ পাওয়ার আর কী উপায় ছিল? কিন্তু কথা তো দিলাম। না ভেবেই দিয়েছিলাম কথাটা—শনিবারের সকাল হতেই ওটা ভাবনার কথা হয়ে দাঁড়াল।

ভাবতে ভাবতে চলেছি, এমন সময় গোবর্ধনের সঙ্গে মোলাকাত—অকূলপাথারে। চৌরাস্তার মোড়ে।

‘গোবর্ধন ভায়া, একটা কথা রাখবে? রাখো তো বলি।’

‘কী কথা বলুন?’

‘যদি কথা দাও যে তোমার দাদাকে বলবে না, তাহলেই বলি তোমায়।’

‘দাদাকে কেন বলতে যাব? দাদাকে কি আমি সব কথা বলি?’

আর কিছু কথা নয়। কথাটা হচ্ছে এই আমাকে শ পাঁচেক টাকা ধার দিতে পারো—দিন কয়েকের জন্য? আজ তো শনিবার? এই বুধবার সন্ধের মধ্যেই—টাকাটা আমি তোমায় ফিরিয়ে দেব!’

‘এই কথা?’ এই বলে আর দ্বিরুক্তি না করে শ্রীমান গোবরা তার পকেট থেকে পাঁচখানা এক শ টাকার নোট বার করে দিল।

টাকা নিয়ে আমি সটান শ্রীহর্ষবর্ধনের কাছে।

‘দেখুন, আমার কথা রেখেছি কি না। লেখক হতে পারি, দরিদ্র লেখক হতে পারি—কথা নিয়ে খেলা করতে পারি, কিন্তু কথার কখনো খেলাপ করি না।’

হর্ষবর্ধন নীরবে টাকাটা নিলেন।

‘আপনি তো ভাবছিলেন যে টাকাটা বুঝি আপনার মারাই গেল। আমি আর এ জন্মেও এ মুখো হব না। ভাবছিলেন যে—’

তিনি বিকল হয়ে বলেন, ‘না না, সেসব কথা আমি আদৌ ভাবিনি। ভাবছি যে এত তাড়াতাড়ি আপনি টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন! আর এত তাড়াতাড়ি আপনার প্রয়োজন কী করে মিটতে পারে? বেশ, ফের আবার দরকার পড়লে চাইতে যেন কোনো কুণ্ঠা করবেন না।’

বলাই বাহুল্য! মনে মনে আমি ঘাড় নাড়লাম। লেখকেরা বৈকুণ্ঠের লোক, কোনো কিছুতেই তাদের কুণ্ঠা হয় না।

শনিবার দিনই দরকারটা পড়ল আবার। হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গোবর্ধনকে গিয়ে দিতে হলো।

‘কেমন গোবর্ধন ভায়া! দেখলে তো, কথা রেখেছি কি না। এই নাও তোমার টাকা—প্রচুর ধন্যবাদের সহিত প্রত্যর্পিত।’

...বুধবার আবার গোবরার কাছে যেতে হলো। পাড়তে হলো কথা—‘গোবর্ধন ভায়া, শনিবার টাকাটা ফেরত দেব বলেছিলাম, শনিবারেই দিইচি, দিইনি কি? এক দিনের জন্যও কি আমার কথার কোনো নড়চড় হয়েছে?...

‘এমন কথা কেন বলছেন?’ গোবর্ধন আমার ভণিতা ঠিক ধরতে পারে না।’

‘টাকাটা আমার দরকার পড়েছে আবার। ওই পাঁচ শ টাকাই। সে জন্যই তোমার কাছে এলাম ভাই! এই শনিবারই তোমায় আবার ফিরিয়ে দেব টাকাটা। নির্ঘাত।’

এভাবে হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন—শনিবার আর বুধবারের দুধারের টানাপোড়েনে আমার ধারিওয়াল কম্বল বুনে চলেছি, এমন কালে একদিন পথে দুজনের সঙ্গেই দেখা। এককালে মোলাকাত।

দুই ভাই পাশাপাশি আসছিল। আমাকে দেখে দাঁড়াল। দুজনের চোখেই কেমন যেন একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি।

হয়তো দৃষ্টিটা কুশল-জিজ্ঞাসা হতে পারে, কোথায় যাচ্ছি কেমন আছি—এই ধরনের সাধারণ কোনো কৌতূহলই হয়তো বা, কিন্তু আমার তো পাপ-মন! মনে হলো দুজনের চোখেই যেন এক তাগাদা।

‘হর্ষবর্ধনবাবু, ভাই গোবর্ধন, একটা কথা আমি বলব, কিছু মনে কোরো না—’ বলে আমি শুরু করি: ‘ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রতি বুধবার হর্ষবর্ধনবাবুকে পাঁচ শ টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি প্রতি শনিবার পাঁচ শ টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধনবাবু, আপনাকে দিতে হবে শনিবার আর গোবর্ধন ভায়া, তোমাকে দিতে হবে বুধবার...হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি শনিবার আর গোবর্ধন, তুমি বুধবার মনে থাকবে তো?—গোবর্ধনকে শনিবার আর হর্ষবর্ধনবাবুকে বুধবার। হর্ষবর্ধনবাবু বুধবার...গোবর্ধন শনিবার...আপনি বুধবার...তুমি শনিবার...আপনি শনিবার...তুমি বুধবার...শনিবার বুধবার...বুধবার শনিবার...বুধবার বুধবার...শনিবার শনিবার...’

‘ব্যাপার কী? হর্ষবর্ধন তো হতভম্ব।—‘কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘ব্যাপার এই যে ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।’

শিবরাম চক্রবর্তী: প্রখ্যাত বাঙালি রম্যলেখক । বাড়ি থেকে পালিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তম উপন্যাস। এছাড়া বাড়ি থেকে পালিয়ের পর, কলকাতার হালচাল, বর্মার মামা, মস্কো বনাম পন্ডিচেরী তাঁর অন্যতম সৃষ্টি। শিবরামের জন্ম ১৯০৩ সালে, মারা গেছেন ১৯৮০ সালে।