আঁকা: আসিফ

এলাকায় আফজাল খান নেতা হিসেবে বেশ জনপ্রিয় বলা যায়। জনদরদি হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু শীতের দিনে খান সাহেবের সবকিছু খান খান হয়ে যায় ঠান্ডার কবলে পড়ে। শীত একদমই সহ্য হয় না তাঁর। তবে গরমের দিনে পার্টি অফিসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বেশ আরামেই থাকেন। শীতের প্রতি নেতার যে ডরভয় কাজ করে, বিরোধী দলের সন্ত্রাসীদেরও এত ভয় পান না। প্রকৃতির খেলা বোঝা বড় দায়!

এই একমাত্র শীতের দিন এলেই আফজাল খান আর মহাকাশচারীর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য চোখে পড়ে না। মানে সাজপোশাকের কথাই বলছিলাম আরকি। পুরো শরীর এমনভাবে ঢাকেন, যেন শীতের তাপনিয়ন্ত্রিত শরীর! এই জ্যাকেটে মোড়ানো নেতার শরীর যেমন দেখা যায় না, ঠিক তেমনই নেতার অবৈধ সম্পত্তির পাহাড়ও কারও চোখে পড়ে না।

লেখাপড়ার দৌড় অবশ্য খুব একটা নেই খান সাহেবের। তাই পাড়ার চায়ের দোকানের পত্রিকা পাঠকদের মুখে শুনে নেন সময়ের হালহকিকত। সেদিন যথারীতি কড়া রোদ ওঠার পর নেতা বাইরে বেরোলেন। চায়ের দোকানে পত্রিকার পাঠক শোনালেন এক খবর!

হঠাৎ খেপে গিয়ে নেতা বললেন, ‘আরে, রাখো তোমার চা! এই শীতের দিনে আমারে কোনো দিন দেখছ স্যান্ডো গেঞ্জি পইরা ঘুরতে? পারলে বরফ দিয়া শরবত বানায়া আনো। খাই আর মাথায় ঢালি।’ ‘পাগল হইয়া গেল নাকি!’ আস্তে করে বলে বউ শরবত আনতে চলে গেলেন।

নেতা খবরটা শুনে চুপচাপ বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলেন। মনে মনে ভাবলেন, এ কেমন সমস্যা রে, ভাই! সত্য প্রবাহ শুরু হইলে আমি আমার এই অবৈধ কার্যকলাপ অর্থাৎ সম্পত্তির কথা বলব ক্যামনে? পাগলের মতো ঘরে পায়চারি শুরু করলেন। উঠানের এমাথা থেকে ওমাথা কয়েকবার চক্কর দিলেন। নেতার বউ অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ‘কী হইছে তোমার? সব ঠিকঠাক আছে?’

নেতা কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, ‘না, ঠিক নাই! বিরাট বিপদ সামনে!’

বউ বললেন, ‘স্থির হইয়া বসেন। আমি চা বানাইয়া দেই।’

হঠাৎ খেপে গিয়ে নেতা বললেন, ‘আরে, রাখো তোমার চা! এই শীতের দিনে আমারে কোনো দিন দেখছ স্যান্ডো গেঞ্জি পইরা ঘুরতে? পারলে বরফ দিয়া শরবত বানায়া আনো। খাই আর মাথায় ঢালি।’

‘পাগল হইয়া গেল নাকি!’ আস্তে করে বলে বউ শরবত আনতে চলে গেলেন।

নেতা বিড়বিড় করে বলছেন, ‘জানি, সত্য একদিন প্রকাশ হবেই। আমি আমারটা নিজ দায়িত্বে আগেই জনগণকে জানিয়ে রাখি। তাহলে ভোটের সময় আমার কদর বাড়বে, কমবে না।’

যেমন ভাবা তেমন কাজ। এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। বিশাল মঞ্চ বানানো হয়েছে। স্কুলের মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। নেতা ভাষণ দেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ জানে না, নেতা আদতে কী বিষয়ের ওপর ভাষণ দেবেন।

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল চারটা। যথাসময়ে নেতা হাজির। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন ডায়াসের সামনে। শুরু করলেন ভাষণ, ‘সুপ্রিয় এলাকাবাসী, শীতের এই বিকেলে আপনাদেরকে উষ্ণ অভিনন্দন। আপনারা আমার ভোটার। আপনাদের কল্যাণে আমি আজ এলাকার নেতা। এলাকার সেবক।’

সবাই কানাঘুষা করছে, ব্যাপারটা কী? খান সাবের চেহারা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন!

আঁকা: আসিফ

এবার নেতা বলে উঠলেন, ‘সবাই একটু চুপ করে আমার কথা শোনেন। আমি এলাকার নেতা, তথা সেবক। তো সেবক হিসেবে কতটুকু সেবা করতে পেরেছি, তার বিচার আপনারাই করতে পারবেন। আজ আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করার জন্য আপনাদের ডেকেছি।’

নেতার কথা শুনে সবাই একে–অপরের মুখ চাওয়া–চাওয়ি করছে।

নেতা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমি যখন প্রথমবার নির্বাচিত হই, তখন আমার জামানত দেওয়ার মতো টাকাও ছিল না। আমার এক বন্ধু তা দিয়ে সহযোগিতা করেন। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমার সহায়–সম্পত্তি শীতের বাতাসের মতো হু হু করে বাড়তে থাকে। আমি পরপর চারবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আর আমার সম্পত্তি বেড়েছে কয়েক শ গুণ!’

জনসমাবেশে শোরগোল পড়ে গেল।

নেতা সবাইকে থামিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘আপনারা হয়তো জানেন না, আমি এই সম্পত্তি করেছি বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে। এমন কোনো অপকর্ম নাই, যা আমার সহযোগিতায় হয় নাই। কিন্তু আজকে আমি অকপটে স্বীকার করে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন আশা করি।’

হইচই পড়ে গেল মাঠজুড়ে। বেসামাল অবস্থা যাকে বলে।

নেতা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এবার বলি শেষ কথা। গতকাল পত্রিকায় একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে লেখা হয়েছে—এ মাসেই আসছে “সত্য প্রবাহ”। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সত্য প্রকাশ করার। আমি আমার সত্য প্রকাশ করে দিয়ে আপনাদের পাশে পেতে চাই।’

এরই মধ্যে নেতার এক চামচা নেতাকে কী যেন বলতে আসছে। মাউথপিসের কাছে মুখ থাকায় কথাটা সবাই শুনে ফেলল। চামচা বলল, ‘নেতা, করছেন কী এটা! খবরটা আসলে শৈত্যপ্রবাহ। মানে শীতের হাওয়া নিয়া খবর! আর আপনি ভাবছেন সত্য প্রবাহ মানে সত্য প্রকাশের প্রবাহ!’