জরুরি বিয়েতে বরযাত্রী হতে চাই মুভমেন্ট পাস

একটু থামুন

আমরা জাতি হিসেবে বেশ রসিক। অন্তত বর্তমান বিধিনিষেধের এমন দিনে তা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। প্রয়োজন খুঁজে পেতে এবং মনের তাগিদে তা আবিষ্কার করতেও আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আর তারই সর্বোচ্চ কল্পনাপ্রসূত ভাবনা হলো এ লেখার শিরোনাম।

এ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এখন নামে-বেনামে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ চলছে। এর আগে ছিল ‘শিথিল’ অবস্থা। এবার অবশ্য ‘শিথিল’ হয়ে গেছে ‘কঠিন’। তবে কবিগুরুর কথা মতোই আমরা ‘কঠিনেরে’ ভালোবাসতে জানি। সেই ভালোবাসা হয় রূপে-রসে টইটম্বুর।

আর সেই সদা ‘রোমান্টিক’ মনের আশা পূরণে ‘জরুরি প্রয়োজন’ তৈরি করতে পারি আমরা। তার জন্য চাইতে পারি মুভমেন্ট পাস। স্থবির জীবন আমাদের দুই চোখের ও দুই কানের বিষ। জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে জেনেও তাই বেরিয়ে পড়ি শিং মাছ কিনতে। তার জন্য মুভমেন্ট পাস নিয়ে চলে যেতে পারি উত্তরা থেকে সদরঘাট। আহা, শিং মাছের ঝোল!

ওই শিং মাছের জন্য এ অঞ্চলের মানুষের মন কেঁদে ওঠে, তাকে কড়াইতে চড়াবে বলে মনের ভেতরে বয়ে চলে কালবৈশাখী। সেই ঝড়ের উদ্দাম বাতাসে তুচ্ছ হয়ে যায় ভিনদেশি করোনা। ভয় উড়ে চলে যায় সুদূর মহাকাশে। আচ্ছা, একটু শিং মাছ না খেয়ে কি দিন কাটানো যায়? কথায় আছে, শখের দাম লাখ টাকা। এ দেশে এখনো শিং মাছের কেজি লাখ টাকা ছোঁয়নি। তবে আর ভিন গাঁয়ের করোনায় ভয় লাগবে কেন?

কিছুদিন আগে, যখন ‘শিথিল’ বিধিনিষেধের চল ছিল, তখন এক সতীর্থ শুনিয়েছিলেন তাঁর বাড়ির সামনের এক বাজারে জমে ওঠা চাক্ষুষ ভিড়ের গল্প। শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসটি কোনোরকমে কিনে বাড়ি ফেরার রসায়ন তা ছিল না। ছিল দস্তুর মতো দরদাম করে, জেনেবুঝে, দশ বিক্রেতার কাছ থেকে যাচাই করে জয়ী হওয়ার এক আখ্যান। মাস্ক পরলে কথা বলতে অসুবিধা হবে বলে অনেকেই তাকে ‘ডিমোশন’ দিয়েছিলেন। তবে ওই সতীর্থ অবশ্য নিজেকে বাঁচাতে মাস্কের প্রমোশনের বিকল্প পাননি। কিন্তু তাতে অনেকের মধ্যে ‘অন্যতম’ হওয়ার তকমা ও কিছু তাচ্ছিল্যের হাসি ছাড়া তাঁর ভাগ্যে অন্য কিছু জোটেনি।

প্রয়োজন—সে বড় জটিল বিষয়। কার কখন কিসের প্রয়োজন হয়, তা কে বলতে পারে? অসুস্থতা ঠেকানোর সময় ও পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহারের ইচ্ছা আমাদের কম থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে কি জীবনে শখ-আহ্লাদ থাকবে না? মহামারি এসেছে বলে কি কেউ বরযাত্রী হবে না?

তা ছাড়া ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে নিতে এতদঞ্চলের জনগণ কিছুটা নারাজ। তাই মাস্ক নাক ঢাকার সুযোগ পায় শুধু রাস্তায় ব্যারিকেড পেলে। আর ধুলা নিবারণের ‘মহৎ উদ্দেশ্যে’ সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে রাস্তা বা ফুটপাত ভেজানোর কথা ভাবছেন? ওটি আমাদের মজ্জাগত বিশেষ ক্ষমতা! এভাবে যখন–তখন, চারপাশের মানুষের শারীরিক উপস্থিতি পুরোপুরি অবহেলা করে ধরণির তপ্ত বুকে শীতল ছোঁয়া দেওয়ার ক্ষমতা কি পৃথিবীর সব মানুষের আছে?

তাই ‘জরুরি সেবা’ নামক শব্দবন্ধটির কথা শুনতে শুনতে আমরা আবিষ্কার করতে পারি ‘জরুরি বিবাহ’। হতেই পারে। প্রয়োজন—সে বড় জটিল বিষয়। কার কখন কিসের প্রয়োজন হয়, তা কে বলতে পারে? অসুস্থতা ঠেকানোর সময় ও পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহারের ইচ্ছা আমাদের কম থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে কি জীবনে শখ-আহ্লাদ থাকবে না? মহামারি এসেছে বলে কি কেউ বরযাত্রী হবে না? আর ‘সীমিত’ পরিসরে ‘জরুরি বিবাহ’ করতে গেলে তো মুভমেন্ট পাস অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কি তাতে ‘সু’নজর দিচ্ছে?

অন্তত নজর দেওয়া উচিত। কতিপয় নাগরিকের মনের ‘হাউস’ বলে কথা! কর্তৃপক্ষ যদি এটুকুই করতে না পারে, তবে লাভ কি বিধিনিষেধ মেনে? তাই কতিপয়ের মনের ইচ্ছা পূরণে মুভমেন্ট পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বিভাগ বা পরিস্থিতির অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি। সেগুলো হতে পারে এমন—১. স্বামী স্ত্রীকে খুশি করতে..., ২. বাবু খেতে চেয়েছে তাই..., ৩. মনের দাবি বড় দাবি, ৪. বিয়ে তো জীবনে একটাই করব, ৫. আড্ডা ছাড়া জীবনের চাকা ঘোরে না, ৬. আমার পেছনে প্রচুর কারেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

দয়া করে সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট ‘প্রয়োজন’-এর কথা বিবেচনা করে এসব নিয়ে ভাবা শুরু করুন। বদল এক দিনে আসে না, তবে আনার কথা মাথায় তো নিতে হবে আগে। তবেই একদিন আমরা হারতে হারতে জিতে যাব। আর মুখ চুন করে আত্মসম্মান হারিয়ে ঘরে ফিরে যাবে করোনারা। ভাইরাস সমাজ কি তাদের আর তখন মেনে নেবে?