শিথিল-শক্তের ফাঁদে, লকডাউন কাঁদে

লকডাউন শিথিল, বাজার সরগরম
ছবি: প্রথম আলো

কখনো শুনি বিধিনিষেধ, কখনো শুনি লকডাউন। একই অঙ্গে তার বহু রূপ। এই লকডাউন বা বিধিনিষেধের মাত্রাও আবার সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। কখনো তা হচ্ছে কঠোর, কখনো সর্বাত্মক, কখনো সবচেয়ে কঠোর, আবার কখনো হয়ে পড়ছে শিথিল। এই শিথিল-শক্তের ফাঁদে লকডাউন বা প্রকারান্তরে বিধিনিষেধের এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।

শব্দ মানুষের সৃষ্টি। এ নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা নেই। কিন্তু প্রাণ না থাকলেও শব্দের অর্থ আছে। তা নিয়েই শব্দগুলোর জীবন কাটে। তবে সেই অর্থ নিয়েই যদি ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়, তবে কতিপয় শব্দের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ দেশের দেশীয় শব্দ হলো বিধিনিষেধ। বারণ করার মতো একটা ব্যাপার এ শব্দে আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মাঝে মাঝে শিথিল হয়ে যাচ্ছে! ফলে সাধারণ মানুষের বোঝার যেমন ঘাটতি হতে পারে, তেমনি শব্দটি নিজেও বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়।

কারণ বিধিনিষেধ নিজেই দেখছে যে নিয়মকানুন বা বারণ থাকছে, আবার শিথিলতাও থাকছে। অর্থাৎ, একটি শিশু তার পোকা খাওয়া দাঁতে চকলেট খেতে চাইছে। মা–বাবা দিয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। তা অমান্য করার কোনো প্রশ্ন উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে শিশুটি লুকিয়ে চকলেট খাওয়া শুরু করে দিল। ওই আমরা করোনা ঠেকাতে যেভাবে থুতনিতে মাস্ক রেখেছিলাম আরকি। মা–বাবা তো রেগে টং। দাঁতের চিকিৎসার ফি তো তাদেরই দিতে হয়। সুতরাং কিছুদিন বকাঝকা চলল। তবে মা–বাবা চকলেট কেনা আর বন্ধ করলেন না। চকলেটও কিনে চোখের সামনে সাজিয়ে রাখলেন, আবার কঠোর বিধিনিষেধও দিলেন। ফলে শিশুটির লুকিয়ে চকলেট খাওয়াও আর বন্ধ হলো না। বিধিনিষেধের শিথিলতা কি এমনই?

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই চলছে কেনাকাটা
ছবি: প্রথম আলো

হতে পারে। এই যেমন শিথিল অবস্থায় এখন মানুষ দৌড়ে, হেঁটে বা গড়িয়ে বাড়ি যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধিকে কাঁচকলা দেখিয়ে। সেই স্বাস্থ্যবিধি মানাতে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, তার প্রতিও বুড়ো আঙুল দেখানো হয়ে গেছে। চেনা-পরিচিত অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে, বাড়িতে তাদের যেতেই হবে এবং ফিরতেও হবে ‘সবচেয়ে কঠোর’ লকডাউন শুরুর আগেই। সংক্রমণ কীভাবে ছড়ায়, করোনা মহামারি শুরুর এত দিন পর কাউকে বোঝানোর অবকাশ থাকার কথা নয়। এখন কেউ যদি বুঝতেই না চান, তবে আর কী করা?

প্রশ্ন হলো, এই যে ঘোরাঘুরির ইচ্ছা, এর পালে বাতাস দিল কে? দিয়েছে একটি শব্দ, শিথিল। ঠিক অনেকটা পোকা খাওয়া দাঁতের সামনে রং-বেরঙের চকলেট সাজিয়ে রাখার মতো। সুতরাং বিধিনিষেধ শব্দবন্ধটি যদি এখন এ বঙ্গে বিভ্রান্ত হওয়ার দাবি জানাতে থাকে, তবে কি তা অযৌক্তিক হবে?

যুক্তির বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে লকডাউনও। ও বেচারার জন্ম আবার পশ্চিম মুলুকে। নিজের দেশে অর্থ পেয়েছে এক রকম, আর এখানে এসে ক্ষণে ক্ষণে নিজের নানাবিধ অর্থ পাচ্ছে সে। যখন কঠোর পরিস্থিতিতেও সে দেখল যে, রাস্তায় গাড়ি বেশুমার, তখন ভাবল—কঠোর বুঝি দেখতে এমনই!

স্বাস্থ্যবিধির কথা মনে করিয়ে দিতে চলছে মাইকিং
ছবি: প্রথম আলো

এরপর লকডাউন দেখল, কঠোরেরও বস আছে। সেই বসের নাম সর্বাত্মক। শুরুতে নামের প্রতি সুবিচার করছিল সর্বাত্মক, তবে কটা দিন যাওয়ার পর দেখা গেল আগে দেখা কঠোর পরিস্থিতির প্রতিশব্দ হয়ে যাচ্ছে সর্বাত্মকও। লকডাউন বুঝল, কঠোর আর সর্বাত্মক ভাই-ভাই। শুধু বোতল ভিন্ন, তেল আগেরটাই।

এদিকে বিদেশি অতিথি লকডাউনের এখন ‘তার ছিঁড়া’ অবস্থা। কঠোর আর সর্বাত্মকের ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর যে আর দিশা খুঁজে পাচ্ছে না সে। এমনকি দিশা পাটানির ছবি দেখেও মনে শান্তি মিলছে না। ভাষাভেদে অর্থের এত বিপুল ফারাক মেনে নেওয়া কি করোনার শত্রুর পক্ষে সম্ভব?

তবে আশায় বাঁচে চাষা। এ বঙ্গে আসার পর দুস্থ হতে বাধ্য হওয়া লকডাউন এখন ‘সবচেয়ে কঠোর’ হওয়ার প্রহর গুনছে। মনের দুঃখ মনে চেপে লকডাউন ভাবছে, এই বুঝি এল তার চোখ মোছার সময়! ওদিকে পশ্চিমা শব্দের এমন নাকানিচুবানি দেখে মিটি মিটি হাসছে কঠোর আর সর্বাত্মক। বিদ্রূপের ঢঙে তাদের ঠোঁট বেঁকানো মন্তব্য, ‘আইজ বুঝবি না, বুঝবি কাইল…!’