বাবার কথা আমাকে ছদ্মনামে লিখতে হচ্ছে ভাবতেই ভেতরটা ডুকরে উঠছে। নিয়তি আমাকে এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যে নিয়তির কিছুই আমি এখানে বলতে পারব না। শুধু বলি, আমি একজন সাধারণ মেয়ে। গৃহবধূ।
মফস্বলের পাঁচজন মেয়ের মতো সাধারণ জীবন হলেও ভেতরের আমিটা কখনোই সাধারণভাবে বেড়ে উঠিনি। কারণ, ছোটবেলা থেকে একটা অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি আমার ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। এই অপূর্ণতা, এই অপ্রাপ্তির নাম—বাবা।
আমি মা-বাবার প্রথম সন্তান। আমার বাবাও ছিলেন দাদা-দাদির বড় ছেলে। মা-বাবার বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর মায়ের গর্ভে আমি আসি। এই খবরে আমাদের পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। থাকতেন মাকে সঙ্গে নিয়ে। আমি পৃথিবীতে আসছি, এই খবর আমার দাদুবাড়িতে বাবা চিঠিতে জানান। তিনি এত খুশি ছিলেন যে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'মা, নতুন অতিথি আসছে আমাদের বাড়িতে। দোয়া কর।'
মায়ের গর্ভে আমার বয়স তখন আড়াই কি তিন মাস। দিনটা নাকি ছিল ১৯৮৯ সালের ১২ জানুয়ারি। সেদিনই বাবা এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার শিকার হলেন, প্রাণ হারালেন।
সেদিন শুধু আমার বাবা মারা যাননি, মারা গেছে একটি পরিবারের স্বপ্ন, একটি অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ।
বাবা নাকি সব সময় চাইতেন প্রথম সন্তান যেন তার মেয়ে হয়। তা–ই হলো বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাস পর। একটা শিশু জন্ম নিলে সবাই খুশি হয়। কিন্তু আমার জন্ম বাবার মৃত্যুশোক পুনরায় জাগিয়ে তুলেছিল। আমার বাবা শিশুদের ভালোবাসতেন। তাই পরিবারের সবাই একটা কথাই নাকি বলত, 'বাবাটা বাচ্চা, বাচ্চা' করে মারা গেল, আর এখন 'বাচ্চাটা বাবা, বাবা' করবে। আমাকে দেখলেই সবার চোখে পানি আসত।
তবে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি সবার। আমার একটু একটু মনে পড়ে, আমার দাদু আমাকে কোলে নিয়ে নীরবে কাঁদতেন। তিনি কোনো দিন ছেলের মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষারোপ বা ক্ষতিপূরণ চাননি। আমার মা আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। আমার চারপাশে অনেক ভালোবাসার মানুষ। এরপরও ভেতরে এমন একটা শূন্যতা। এই শূন্যতা
কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়। শুধু মনে হতে থাকে, বাবা থাকলে হয়তো আমার জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। এই যে শূন্যতা, বড় কষ্ট দেয় সব সময়।
বাবার কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই। কিন্তু সবাই বলে আমার নাকটা, চোখটা, হাত-পা নাকি আমার বাবার মতো। এটাই আমার বড় পাওয়া। বাবা চলে গেছেন আমার জন্মের আগে কিন্তু বেঁচে আছেন আমার মধ্যে। এই জনমে বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার, তাই পুনর্জন্মে যেন বাবার মেয়ে হয়েই জন্ম হয়। আর বাবার জন্য আমার অভিমানী সুর—
আকাশের ওই নীলের মাঝে খুঁজে ফিরি তোমায়
কোথায় তুমি হারিয়ে গেছ, একা করে আমায়
মনে আমার ভাসে আজও অজানা সেই স্মৃতি
এত সহজে টানলে কেন ভালোবাসায় ইতি।