সমকালীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

মনপুরা
মনপুরা

বিগত এক দশক হলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সংকটকাল। একের পর এক বন্ধ হয়েছে প্রেক্ষাগৃহ, এক হাজার ২০০ থেকে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা প্রায় ৪০০-তে এসে ঠেকেছে। আবার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গতি-প্রকৃতি কীভাবে পাল্টে পুরোনো স্রোতে ফিরিয়ে আনা যায়, তার উদ্যোগের কালও এটি। সার্বিকভাবে ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতি খারাপ হলেও, ইন্ডাস্ট্রির বাইরে স্বাধীনধারায় এই সময়কালেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে। এই সময়েই নির্মিত হয়েছে মাটির ময়না, রানওয়ে, খেলাঘর, আমার বন্ধু রাশেদ, শঙ্খনাদ, নিরন্তর কিংবা আহা!,থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ও গেরিলার মতো গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র। হঠাৎ ঝলকের মতো এই সময়ে নির্মিত হয়েছে মনপুরার মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। ফলে এই সংকটকালেও আমরা পেয়েছি বিচিত্র বিষয়ের অনন্য সব চলচ্চিত্র। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি যৌথভাবে আয়োজিত সমকালীন দেশীয় চলচ্চিত্রের উৎসব, ২০১৩-এর সফল সমাপ্তির প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর দিকে তাকালে এমনটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
বিগত এক দশকে প্রায় ৫৫০টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার মধ্য থেকে উৎসব কমিটি মনোনীত জুরিবোর্ড ২০০২ থেকে ২০১২—এই সময়কালের ১৯ জন চলচ্চিত্রকারের ২০টি চলচ্চিত্র নির্বাচন করেছিল। চলচ্চিত্রগুলো হলো এনামুল করিম নির্ঝরের আহা! (২০০৭), আবু সাইয়ীদের শঙ্খনাদ (২০০৪), তানভীর মোকাম্মেলের লালন (২০০৪), গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা (২০০৯), নোমান রবিনের কমন জেন্ডার (২০১২), নাসির উদ্দীন ইউসুফের গেরিলা (২০১১), কোহিনূর আক্তার সুচন্দার হাজার বছর ধরে (২০০৫), কাজী মোরশেদের ঘানি (২০০৬), মুরাদ পারভেজের চন্দ্রগ্রহণ (২০০৮), হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া (২০০৪), তৌকীর আহমেদের জয়যাত্রা (২০০৪), মোরশেদুল ইসলামের প্রিয়তমেষু (২০০৯), তারেক মাসুদের মাটির ময়না (২০০২) ও রানওয়ে (২০১০), চাষী নজরুল ইসলামের সুভা (২০০৬), নূরুল আলম আতিকের ডুবসাঁতার (২০১১), টোকন ঠাকুরের ব্ল্যাকআউট (২০০৬), কবরী সারোয়ারের আয়না (২০০৬), মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার (২০০৯) ও সাইদুল আনাম টুটুলের আধিয়ার (২০০৮)।

মাটির ময়না
মাটির ময়না

এক দশকের দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে এ রকম উৎসব এর আগে দেখা যায়নি। তাই আয়োজক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। বলা যায়, এই চলচ্চিত্রগুলো সমকালীন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একটি শোকেস, প্রতিনিধিত্বকারী চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রগুলোই এই সময়ের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র, তা নয়। তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম কিংবা আবু সাইয়ীদ কিংবা অন্যরা এই সময়েই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যা এই তালিকায় আসেনি।
নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর প্রায় সবই জীবনঘনিষ্ঠ ও শিল্পপ্রয়াসী চলচ্চিত্র। বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই নানা শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে, অনেকগুলোই পৃথিবীর নানা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে, কোনো কোনোটি অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার (মাটির ময়না ও গেরিলা)। মাটির ময়না ইউরোপ-আমেরিকায় বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পেয়েছে, শঙ্খনাদ ইউরোপে মুক্তি পেয়েছিল।
নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর কোনো কোনোটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেও (যেমন মনপুরা), এফডিসিনির্ভর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ফর্মুলার বাইরে পড়েছে প্রতিটি চলচ্চিত্রই, যদিও এর বেশ কয়েকটি (সুভা, আয়না ও ঘানি) এফডিসির মূলধারার প্রডাকশন সিস্টেমের ভেতরে থেকেই নির্মিত হয়েছে। তবে এফডিসির উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থার বাইরে স্বাধীনধারায় নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র (মাটির ময়না, রানওয়ে, ব্ল্যাকআউট ও লালন)। স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলোর কোনো কোনোটি আবার বৈদেশিক অর্থসহায়তা পেয়েছে। তবে নির্বাচিত ২০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১১টি চলচ্চিত্রেরই প্রযোজক এককভাবে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।
বিষয় হিসেবে দেখলে চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে চারটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক (মাটির ময়না, শ্যামল ছায়া, জয়যাত্রা ও গেরিলা)। বাংলাদেশের সৃজনশীল ও সিরিয়াস চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রনির্মাণের একটা প্রবণতা লক্ষণীয়। আবার শিল্পপ্রয়াসী চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই যে সাহিত্যনির্ভর হবে, এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সাতটি চলচ্চিত্রই (সুভা, শ্যামল ছায়া, হাজার বছর ধরে, শঙ্খনাদ, গেরিলা, প্রিয়তমেষু ও চন্দ্রগ্রহণ) সাহিত্যনির্ভর।
জীবনঘনিষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অথবা সামাজিক-সংকটের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরুণ পরিচালকেরা পারসোনাল বা ব্যক্তিগত চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। তার প্রেম-অপ্রেম, একাকিত্ব-বিষণ্নতা, মনোবিকলন, যৌনতা ইত্যাদি চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
এ রকম কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, ডুবসাঁতার ও ব্ল্যাকআউট। বিশ্বায়ন-উত্তর এবং উত্তরাধুনিক কালে একটি নাগরিক প্রেক্ষাপটে সব বৃহৎ নগরেই এ ধরনের চলচ্চিত্র বেশি মাত্রায় নির্মিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও সম্প্রতি এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, তার প্রমাণ এই কয়েকটি চলচ্চিত্র।
নারীর অধিকার বা নারীর সংগ্রাম উত্তরাধুনিক সময়ে আলোচিত প্রবণতা বা আন্দোলনের বিষয়বস্তু। পুরুষতান্ত্রিক পীড়নের শিকার নারীর রূপায়ণ চলচ্চিত্রেও দেখা যাবে, তা-ই স্বাভাবিক। প্রিয়তমেষু, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, আয়না ও হাজার বছর ধরে এ রকম কয়েকটি চলচ্চিত্র। আবার জেন্ডার পলিটিকসের জায়গায় অনন্য চলচ্চিত্র কমন জেন্ডার।
সমসাময়িক সামাজিক-সংকটও সমাজসচেতন চলচ্চিত্রকারদের বিষয় হয়ে ওঠার কথা। রানওয়ে ও আয়না—এ রকম দুটি চলচ্চিত্র। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের আওতায় চলচ্চিত্রেও শ্রেণীশোষণ, সাধারণ মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম, তার দারিদ্র্য বরাবরই এ মাধ্যমের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রের মধ্যে আধিয়ার, ঘানি এবং কিছু মাত্রায় মনপুরা এ ধরনের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে।
চলচ্চিত্রগুলো যেসব বর্গে ফেলে আলোচনা করা হয়েছে এতক্ষণ, তার বাইরে পড়েছে লালন ও আহা!। ঊনবিংশ শতকের মরমি কবি ও দার্শনিক লালন ফকিরের জীবনীনির্ভর চলচ্চিত্র হলো লালন। আহা! চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে নগরায়ণের প্রবল চাপে পর্যুদস্ত পুরান ঢাকার হেরিটেজ বিল্ডিংগুলো। আধুনিক স্থাপত্যের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য।
বিষয়ের বিচিত্রতা ছাড়া অপেক্ষাকৃত তরুণ পরিচালকদের মধ্যে চলচ্চিত্রভাষায় নিরীক্ষাপ্রবণতাও লক্ষণীয়, যা একটি শুভ লক্ষণ। শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রে বিষয়ের তুলনায় আঙ্গিক কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ব্ল্যাকআউট, ডুবসাঁতার ও কমন জেন্ডার চলচ্চিত্রে এই নিরীক্ষাপ্রবণতার ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। অগ্রজদের নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে শঙ্খনাদ ও রানওয়ে চলচ্চিত্রেও নিরীক্ষার দেখা মেলে।
সমকালীন এই চলচ্চিত্রগুলো নানা বৈভবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও, ছবিগুলোয় বাংলাদেশের নিজস্ব স্বর এবং নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষা আলাদা করে চোখে পড়ে না। বিদেশে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রায়ই ভারতীয় বা ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিজস্ব বিকাশের জন্য বিষয়টি সম্মানজনক নয়।
অন্য শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রে যা-ই হোক না কেন, দুই বঙ্গের চলচ্চিত্রের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস আলাদা। ফলে আজকের ও ভবিষ্যতের চলচ্চিত্রকারদের বাংলাদেশের নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষা তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হবে।