সততার দোকান

দোকানির পরিবর্তে একটি কাগজে পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানো থাকে। প্রয়োজনীয় পণ্যটি সংগ্রহের পর তা নিজ দায়িত্বেই পরিশোধ করে শিশুরা ষ ছবি: প্রথম আলো
দোকানির পরিবর্তে একটি কাগজে পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানো থাকে। প্রয়োজনীয় পণ্যটি সংগ্রহের পর তা নিজ দায়িত্বেই পরিশোধ করে শিশুরা ষ ছবি: প্রথম আলো

একটা টেবিলের ওপর তিনটি প্লাস্টিকের ঝুড়ি। তাতে খাতা, কলম, পেনসিল, রাবার, স্কেল, পেনসিল কাটার, নেইল কাটার সাজিয়ে রাখা। পাশেই একটি কাগজে প্রতিটির দাম লেখা। সেখানে একটা ছিদ্র করা কৌটা রাখা। শিশুরা আসছে, যে যার দরকারমতো ঝুড়ি থেকে খাতা, কলম, পেনসিল বা রাবার তুলে নিয়ে কাগজে লেখা দাম দেখে ওই ছিদ্র করা কৌটার মধ্যে নির্দিষ্ট টাকা (দাম) ফেলে চলে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটা কোনো দোকান নয়, এটা শিশুদের সততা চর্চার একটা কেন্দ্র।

২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের জমিদারবাড়িতে ‘লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন’-এ শিক্ষাপণ্য কেনার এই ব্যতিক্রমী দোকান চালু করা হয়। এই দোকানে কোনো বিক্রেতা নেই। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আন্দুলিয়া আকুঞ্জি পরিবারের সন্তান, মানিকগঞ্জে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ এম কামরুল ইসলাম এই দোকানের উদ্যোক্তা। এটি ছাড়াও তিনি ও তাঁর ভাই শিল্পপতি এ এম হারুনার রশীদ ১৯৯২ সালে উপজেলার শাহপুর বাজারে তাঁদের বাবার নামে ‘ওয়াছেক আলী শিক্ষা প্রকল্প’ ও মায়ের নামে ‘সকিনা আলী সেবা প্রকল্প’ চালু করেন। সেই থেকে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডুমুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার কৃতী শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা, দরিদ্র-মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।

গত সোমবার সকালে ওই স্কুলের অফিস কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে কক্ষের এক পাশে একটি টেবিলের ওপর ঝুড়িতে করে পেনসিল, স্কেল, কলম, রাবারসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ রাখা আছে। পাশেই প্রতিটির দাম লেখা। শিক্ষার্থীরা এসে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যটি নিয়ে কৌটার মধ্যে টাকা রেখে যাচ্ছে। স্কুলের শিক্ষক ও দোকানটির দেখভালকারী শাহিনা বেগম বলেন, ‘২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কামরুল ইসলাম আমাদের স্কুলে এসে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের নিয়ে একটা সভা করেন। সেখানে তিনি শিশুদের মধ্যে সততার বোধ জাগানোর জন্য “সোনামুখ সততা শপিং” নামের এই দোকান চালুর ঘোষণা দেন। ওই দিনই তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাড়ে ১৩ হাজার টাকার খাতা, কলম, পেনসিল, রাবার, স্কেল, পেনসিল কাটার, নেইল কাটার আনিয়ে দোকানটি চালু করেন।

এই দোকানে কেনা দামেই সব জিনিস বিক্রির দাম ঠিক করা হয়। কোনো লাভ করা হয় না। প্রতি শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জমা হওয়া টাকা গুনে আবার নতুন করে পণ্য আনা হয়। সপ্তাহ শেষে মালামাল ও টাকা মিলিয়ে দেখা গেছে, কখনো টাকা কম পড়েনি, বরং কখনো কখনো দু-এক টাকা বেশিই হয়।’ ওই দোকান থেকে একটা স্কেল কিনতে আসা তৃতীয় শ্রেণীর সুবিদ সুন্দর তরফদার বলে, ‘বাইরের দোকান থেকে এ দোকানে দাম কম। তা ছাড়া কেউ টাকা চাচ্ছে না, আমি নিজেই টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছি। এ জন্য আমার খুব মজা লাগে।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কিরণ চন্দ্র বৈরাগী বলেন, ‘এই দোকানের মাধ্যমে শিশুদের সততা ও সত্যবাদিতা শেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, এটা ভবিষ্যতে তাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখবে।’
ওয়াছেক আলী শিক্ষা প্রকল্প ও সকিনা আলী সেবা প্রকল্পের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এ এম কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের জন্য ক্ষুদ্র হলেও কিছু করার চেষ্টা করছি।’