দেহঘড়ির সন্ধান করে নোবেল

সুইডেনের নোবেল কমিটি সোমবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে চলতি বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। ছবি: এএফপি
সুইডেনের নোবেল কমিটি সোমবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে চলতি বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। ছবি: এএফপি

‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি, কোন মিস্তিরি বানাইয়াছে?’ বহু বছর আগে প্রশ্নটি রেখেছিলেন আবদুর রহমান বয়াতি। আর এ বছর এই প্রশ্নের উত্তরে দেহঘড়ির নির্মাতা হিসেবে ‘জিন ও তার নির্দেশনায় উৎপন্ন প্রোটিনের’ সন্ধান দিয়ে নোবেল জিতেছেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানী। গত শতকে বাংলাদেশের এক বয়াতির ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের মীমাংসা করেই এ তিন বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন—এমন দাবি অবান্তর। কারণ, মাঝখানে রয়েছে মহাদেশের ব্যবধান, যে দূরত্ব খোদ প্রাত্যহিক চেনা ঘড়িটিকেই উল্টে দেয়। কিন্তু দূরত্ব ও ভাষার বিচারে এ ব্যবধান সত্ত্বেও যোগসূত্রটি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।

এ অঞ্চলের বাউল শিল্পীরা যুগ যুগ ধরেই দেহ ও জগৎকে এক করে দেখেছেন। ‘যা নেই ভাণ্ডে, তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে’ এ আপ্তবাক্যকে ধারণ করে তাঁরা যে পরম্পরার জন্ম দিয়েছেন, তারই এক প্রান্তে জন্ম হয় আবদুর রহমান বয়াতির, যিনি নেমেছিলেন দেহঘড়ির সন্ধানে। তাঁর এ গান এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, গত শতকের ৯০-এর দশকে জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড ফিডব্যাকের সঙ্গে যুগলবন্দী হয়ে নতুন সংগীতায়োজনে সবার সামনে হাজির হয় ‘দেহঘড়ি’। এ যেন প্রজন্মান্তরে চালিত হওয়া সর্বব্যাপী অনুসন্ধান কার্যক্রম। এ বছর নোবেল কমিটির ঘোষণায়ও এ ঐতিহাসিক সত্য হাজির হয়েছে। তাঁরা বলছেন, ‘পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে জীবজগতের এক অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে। এমন ধারণা বহু প্রাচীন হলেও তার কোনো প্রমাণ মিলছিল না। আর এ প্রমাণটিই সবার সামনে হাজির করে নোবেল জিতে নিয়েছেন মার্কিন তিন বিজ্ঞানী।’

এ বছর চিকিৎসায় নোবেল পেয়েছেন জেফরি সি হল, মাইকেল রোজব্যাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং। এ তিন মার্কিন জিনবিজ্ঞানী বলছেন, দেহের অভ্যন্তরে একটি ঘড়ি রয়েছে, যা বহির্জগতের সঙ্গে জীবজগতের মেলবন্ধনটি তৈরি করে। এ ঘড়িই নির্মাণ করে ঘুম ও জাগরণের এক অনিঃশেষ চক্র, যার ওলটপালটে বদলে যেতে পারে অনেক কিছু। এ অনেক কিছুর তালিকাটিও আবার ছোট নয়। এর মধ্যে রয়েছে বিপাক ক্রিয়া, হৃৎক্রিয়া, মন ও মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা। এর একটু ওলটপালটেই বদলে যেতে পারে সংশ্লিষ্ট প্রাণীর আচরণ।

বেঁচে থাকলে আবদুর রহমান বয়াতি নিশ্চয় আজ গর্ব করতেন। কারণ, ২০১৩ সালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যাওয়া এ শিল্পী তাঁর যুবাবয়সেই নেমেছিলেন দেহঘড়ির সন্ধানে। এখানেই ক্ষান্ত হননি তিনি। নিজের মতো করে এর স্বরূপটিও সবার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। তিনি বলছেন, ‘একখান চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া, জনম ধইরা চলতে আছে।’

নোবেল পাওয়া মার্কিন বিজ্ঞানী ত্রয়ীও বলছেন, সপ্রাণ জীব মাত্রই দেহঘড়ির বাহক। আবদুর রহমান বলছেন, ‘মাটির একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিছে তার ভিতর।’ আর মেশিনের পরিচয় হিসেবে একটি বিশেষ জিনের কথা জানান দিয়েই পুরস্কার জিতেছেন তিন জীববিজ্ঞানী। বাংলাদেশের বাউল কথা বলেছেন বাউলের ঢংয়ে। সন্ধান করেছেন নিজস্ব পথে। প্রশ্ন রেখেছেন। আবার ‘প্রেম নয়নে’ খোঁজার কথা বলে উত্তর সন্ধানেরও পথ বাতলে দিয়েছেন তিনি। জেফরি সি হল, মাইকেল রোজব্যাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং এ প্রেম নয়নেই অনুসন্ধান করেছেন নিশ্চিত, যার আরেক নাম বিজ্ঞান।