মিয়ানমারেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার তাগিদ

>
  • নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক।
  • রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের ওপর গুরুত্ব আরোপ।
  • রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা।
  • নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে আছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গতকাল মঙ্গলবারের বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, যে সমস্যার শুরু মিয়ানমারে, সেখানেই সমাধান খুঁজে পেতে হবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে আছে।

নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ও জাতিসংঘে কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আল ওতাইবি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি আম্মান থেকে ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি এখনো শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য অনুকূল নয়। যে ৬ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা যথেষ্ট নয়।

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, কখন তারা ফিরে যাবে, একমাত্র রোহিঙ্গারাই সে সিদ্ধান্ত নেবে। সে জন্য রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মিয়ানমারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দফায় দফায় ভয়াবহ নৃশংসতা, বাস্তুচ্যুতি আর তাদের রাষ্ট্রহীন করার চেষ্টা বন্ধ করতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।

বৈঠকের শুরুতে জাতিসংঘের রাজনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক সহকারী উপমহাসচিব মিরোস্লাভ ইয়েনচা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, রাখাইন রাজ্যে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বন্ধ হয়নি। এখনো প্রতিদিন অনেক রোহিঙ্গা সীমান্তের অন্য পাশে আশ্রয় নিচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে ওই সম্প্রদায়ের নাগরিকত্বের প্রশ্ন। প্রশ্নটির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হবে না।

যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত স্থায়ী প্রতিনিধি জনাথন অ্যালেন বলেন, গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন মিয়ানমার সফরের সময় সে দেশের নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে শরণার্থী প্রত্যাবাসনে যথাযথ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তাঁর দেশের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা হয়েছে তা জাতি নির্মূলের অভিযান। একমাত্র মিয়ানমারের পক্ষেই সম্ভব এই অবস্থা পরিবর্তন করা। তিনি বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সঙ্গে আছে।

জাতিসংঘে ফ্রান্সের স্থায়ী প্রতিনিধি ফ্রাঁসোয়া দেলাখতে বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যার ব্যাপারে রয়টার্স যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা যেতে পারে।

অবশ্য চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি মা ঝাওজু মন্তব্য করেন, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পরিস্থিতি যথেষ্ট অনুকূল নয়, এ কথা স্বীকার করে বাংলাদেশকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন তিনি।

জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি বলেন, রাখাইন রাজ্যে কী ঘটছে তা গোপন রাখার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করছে। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বিশ্ব অপেক্ষা করছে। এ সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদ এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।  সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কোনো অজুহাত না দিয়ে পরিষদকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 

রাশিয়ার উপ–স্থায়ী প্রতিনিধি ইউজেনি জাগাইনভ বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। যারা সেখানকার ঘটনাবলিকে বিশেষ হিসেবে অভিহিত করে পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, তারা সমস্যার সমাধান শুধু বিলম্বিতই করছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে তা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি। রয়টার্স গণহত্যার যে প্রতিবেদন ছেপেছে, সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্তের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির কারণ ধর্মীয় নয়। মিয়ানমার সরকার শুধু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যকলাপ রোধেই ব্যবস্থা নিয়েছে।

বৈঠকের শেষ বক্তা ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, রাখাইনে সহিংসতা অব্যাহত থাকায় এখনো সেখান থেকে প্রতিদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হলেও এ নিয়ে কোনো কার্যকর অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। রোহিঙ্গাদের মাঝে এখনো প্রবল ভীতি কাজ করছে। তারা ফিরে যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফিরে গেলে কোথায় থাকবে, সেই নিশ্চয়তা চায়। তারা নিজেদের গ্রামে ও বাড়িতে ফিরতে চায়, কোনো অস্থায়ী শিবিরে নয়। রোহিঙ্গাদের কল্যাণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।