যুদ্ধ, অবরোধ ও দারিদ্র্যে ধ্বংসে পরিণত গাজা

গাজা সীমান্তে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গত শুক্রবার ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে গুরুতর আহত হন ফিলিস্তিনের সাংবাদিক ইয়াসির মুর্তজা। দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে বাঁচানো যায়নি। গতকাল শনিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।  ছবি: রয়টার্স
গাজা সীমান্তে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গত শুক্রবার ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে গুরুতর আহত হন ফিলিস্তিনের সাংবাদিক ইয়াসির মুর্তজা। দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে বাঁচানো যায়নি। গতকাল শনিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ছবি: রয়টার্স

দারিদ্র্যে জর্জরিত জনাকীর্ণ উপকূলীয় উপত্যকা গাজা। বর্তমানে এই উপত্যকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস। গাজার ইসরায়েলের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্ত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সহিংসতার আগুনে জ্বলছে। গত ৩০ মার্চ ফিলিস্তিনিদের ভূমি দিবস উপলক্ষে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১৯ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার জেরে নতুন করে জ্বলে ওঠে এই উপত্যকা। ওই দিন আহত হয় কয়েক শ ফিলিস্তিনি। বলা হচ্ছে যে ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর গাজায় এটিই সবচেয়ে প্রাণহানির ঘটনা। এরপর ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতায় নিহত হয়েছে আরও ১১ ফিলিস্তিনি।

ভূমধ্যসাগরের তীর বরাবর প্রাচীন বাণিজ্য ও নৌপথের ধার ঘেঁষে অবস্থানরত গাজা উপত্যকা ১৯১৭ সালের আগে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। গত শতকে এটি ব্রিটিশদের থেকে মিসরীয়, এরপর ইসরায়েলের সামরিক শাসনের অধীনে আসে। বর্তমানে এখানে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস। মাত্র ১৪০ বর্গমাইল এলাকায় তাদের বসবাস যা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটিতে পরিণত করেছে গাজাকে।
১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরপরই ইহুদি ও আরবদের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকে। ১৯৪৮-৪৯ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের গঠনের পর গাজা মিসরীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু মিসর কখনোই গাজা অধিগ্রহণ করেনি।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পরিণতিতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হওয়া হাজারো ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয় গাজায়। ১৯৬৭ সালের জুনে ছয় দিনের যুদ্ধে মিসর থেকে গাজা দখল করে নেয় ইসরায়েল।
২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর একতরফাভাবে গাজা থেকে অধিবাসী এবং সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয় ইসরায়েল। এতে ৩৮ বছরের ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ঘটে। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৬ সালে এক ইসরায়েলি সেনাকে আটকের অভিযোগে গাজায় অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। এদিকে ২০১৩ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি উৎখাত হওয়ার পর গাজার রাফাহ সীমান্ত প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় কায়রো। তখন থেকে গাজার একমাত্র প্রবেশদ্বার ইসরায়েলের আর নিয়ন্ত্রণে নেই।

গাজায় অবরোধ ও হত্যা বন্ধের দাবিতে মধ্য লন্ডনে গতকাল বিক্ষোভ।  ছবি: এএফপি
গাজায় অবরোধ ও হত্যা বন্ধের দাবিতে মধ্য লন্ডনে গতকাল বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, অবরোধের কারণে গাজায় জিডিপির ক্ষতি হয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। গাজায় নেই কোনো শিল্প। পানি ও জ্বালানির মারাত্মক সংকট রয়েছে সেখানে। ভূগর্ভস্থ পানির ৯৫ শতাংশের বেশি পানের উপযোগী নয়। সেখানে বেকারত্বের হার ৪৫ শতাংশ। উপত্যকাটির দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল।

গাজায় বিভিন্ন সময়ে একের পর এক অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল। গাজা থেকে ছোড়া রকেট নিক্ষেপে এক ইসরায়েলির মৃত্যুর জেরে ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ ‘হট উইন্টার’ নামে অভিযান চালায় ইসরায়েল। এতে ১২০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এরপর জুনে যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত রকেট হামলা ও ইসরায়েলের পাল্টা হামলা অব্যাহত থাকে। তখনো শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ওই বছরেরই ২৭ ডিসেম্বর ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ নামে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। সে সময়ে ১ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি এবং ১৩ ইসরায়েলি নিহত হয়। ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতিতে এই হত্যাযজ্ঞ হয়ে থাকে। এরপর ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শীর্ষ হামাস কমান্ডার আহমেদ জাবারিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ‘অপারেশন পিলার অব ডিফেন্স’ নামে ইসরায়েল আরেক অভিযান শুরু করে। আট দিনের ওই অভিযানে ১৭৭ ফিলিস্তিনি এবং ৬ ইসরায়েলি নিহত হয়। এরপর মিসরের মধ্যস্থতায় কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি। সবশেষ ২০১৪ সালের ৮ জুলাই গাজার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’ নামের বিশাল এক অভিযান চালায় ইসরায়েল। উদ্দেশ্য, গাজা থেকে রকেট হামলা এবং বিদ্রোহীদের সুড়ঙ্গ খোঁড়া বন্ধ করা। ওই যুদ্ধে ফিলিস্তিনের ২ হাজার ২৫০ জন নিহত হয়। অপরদিকে ইসরায়েলের পক্ষে নিহত হয় ৭৪ জন।
২০১৭ সালের অক্টোবরে হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে হওয়া চুক্তিতে আশা জেগেছিল যে গাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যে নিয়োজিত জাতিসংঘের শান্তি দূত নিকোলায় ম্লাদেনভ চলতি বছরের জানুয়ারিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পুরোপুরি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গাজা উপত্যকা।