কলকাতায় সম্প্রীতির সুরে বেঁধে পথে পথে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বর্ষবরণ

কলকাতায় পয়লা বৈশাখকে বরণ করতে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
কলকাতায় পয়লা বৈশাখকে বরণ করতে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

প্রথম অনুপ্রেরণা এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালনে এত জাঁকজমকপূর্ণ, এত উৎসাহ-উদ্দীপনা, তারই সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখে কলকাতার সংস্কৃতিপ্রেমীদের মনে অনুপ্রেরণা আসে—তাহলে তো কলকাতায় বাংলা নববর্ষ পালনে আয়োজন করা যায় মঙ্গল শোভাযাত্রা! সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যান কলকাতার সংস্কৃতিপ্রেমীরা। ছুটে যান ঢাকায়। কথা বলেন ঢাকার চারুকলার ছাত্রছাত্রী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁরাও আশার বাণী শোনান কলকাতার সংস্কৃতিপ্রেমীদের। কলকাতার ডাকে ছুটেও আসেন ঢাকার চারুকলার শিল্পীরা। এরপর গত বছরই প্রথম কলকাতার রাস্তায় সম্প্রীতির বন্ধন জোরদার করার প্রত্যয় নিয়ে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।

এবার সেই লক্ষ্যে দ্বিতীয় বছরের মঙ্গল শোভাযাত্রার পালা। তবে গত বছর একটি মঙ্গল শোভাযাত্রা হলেও এবার হচ্ছে কয়েকটি। সম্প্রীতির সুর বেঁধে আজ কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। সবারই কণ্ঠে এক আওয়াজ ছিল—নববর্ষে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা, আমরা দেশ গড়ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে। সাম্প্রদায়িক বিভেদকে ছুড়ে দিয়ে। দেশ গড়া হবে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা দিয়ে। দেশ হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আদর্শ পীঠস্থান।

বস্তুত, মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা কলকাতার মানুষ শুনেছে ঢাকা থেকে। তাই তো ঢাকার অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতায় এবারও কলকাতার রাজপথে বের হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মানুষ ভাবতেই পারেনি এত ভিড় হবে এবারও। রোদ উপেক্ষা করে আজ রোববার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কলকাতাবাসীকে চমকে দিয়েছে, থমকে দিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিক্ষা দিয়েছে। সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মন্ত্র দিয়েছে।

রোববার সকাল আটটায় দক্ষিণ কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। আর শেষ হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দানে। এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন রিকশাচালক নজর আলি। নজর আলির গুণ, তিনি রিকশা চালান হাতে বাঁশি বাজিয়ে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার, চিত্র পরিচালক রাজা সেন, সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুমন পাল ভিক্ষু প্রমুখ।

নববর্ষ বরণের আয়োজনে শামিল হয়েছে ভাষা ও চেতনা সমিতি। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
নববর্ষ বরণের আয়োজনে শামিল হয়েছে ভাষা ও চেতনা সমিতি। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

বাংলা নববর্ষ পালনের রেওয়াজ সুদূর অতীত থেকে চলে আসছে কলকাতায়। তবে বাংলাদেশে যেভাবে ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়, সেভাবে কিন্তু কলকাতায় হতো না, এখন হচ্ছে। বাংলাদেশে অবশ্য আছে প্রাণে ছোঁয়া আর আবেগভরা অনুষ্ঠান। নববর্ষের মেলা—সেই ইলিশ-পান্তা থেকে চিড়ামুড়ি-বাতাসা-কদমা আর দই-মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজ। আর কলকাতায়ও তা শুরু হয়েছে।

কলকাতায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে কলকাতার, ‘বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন পরিষদ’। পরিষদের আহ্বায়ক হলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য অধ্যাপক সিদ্ধার্থ দত্ত।

এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঘিরে দক্ষিণ কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় তিন কিলোমিটার পথজুড়ে ছিল নানা আলপনার ছাপ। ছিল কাঠি নাচ, সাঁওতালি নাচ, রণপা নৃত্য, ঐতিহ্যের গান, লোকগীতি, ঢাকির দলের ঢাকের বাজনা আর শ্রুতি নাটক। এবারও এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল বিক্রমপুরের ঘোড়া, সুন্দরবনের বাঘ, বাঁকুড়ার প্যাঁচা। ছিল দুই বাংলার শিল্পীদের তৈরি মুখোশ। হাতি, ঘোড়া, প্যাঁচা, কালীঘাটের পটচিত্র, পাখা, কুলো আরও কত কি? শিশুরা সেজেছে সাত ভাই চম্পা, হাট্টিমাটিম টিম, লাল কমল, নীল কমল আরও নানা রূপকথার সাজে। ছিল সুন্দরবনের মানিক পীরের গান, গাজি পীরের গান আর দুই বাংলার অতীত দিনের লোকগান। ছিল রাস্তাজুড়ে নানান আলপনা। আর এই মুখোশ বানানোর জন্য ঢাকা থেকে এসেছেন চার শিল্পীর একটি দলও। আরও উপস্থিত ছিলেন শিল্পী সাইদুল হক ও আমিনুল হাসান।

পাশাপাশি এবার আরেকটি মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়েছে দক্ষিণ কলকাতার সুকান্ত সেতু থেকে আর সেটি শেষ হয় ঢাকুরিয়ায়। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়েছে ‘বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন পরিষদ’-এর নামে। এই মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, কলকাতার সাবেক মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য, আজিজুল হক, সাংবাদিক উর্মি রহমান প্রমুখ। তা ছাড়া এদিন আরও একটি মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করেছে কলকাতার ভাষা ও চেতনা সমিতি। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় কলকাতার জাদুঘরের সামনে থেকে। শেষ হয় রবীন্দ্রসদনে। এই মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপহাইকমিশনার তৌফিক হাসান। উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী শোভন দেব চট্টোপাধ্যায়, কলকাতার সাবেক মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য, কবি সুবোধ সরকার, অধ্যাপক ইমানুল হক, কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের প্রথম সচিব (প্রেস) মোফাকখারুল ইকবাল প্রমুখ। এতে যোগ দেন কলকাতার বিশিষ্টজনেরা।

বর্ণাঢ্য আয়োজনে নববর্ষ বরণ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
বর্ণাঢ্য আয়োজনে নববর্ষ বরণ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে শুরু হয় নববর্ষের অনুষ্ঠান। চলেছে রাত অবধি। যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ, আসাম ও ত্রিপুরার শিল্পীসহ কলকাতার শিল্পীরা। এ ছাড়া বহরমপুরেও বের হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়েছে হুগলির উত্তর পাড়ায় ডা. বিসি রায় মেমোরিয়াল সমিতির উদ্যোগেও।

মোটকথা, জমজমাট ছিল কলকাতার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় পা মিলিয়েছেন কলকাতার বহু বিশিষ্টজন। হাজারো মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত ছিল এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। আর এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সুন্দর করার জন্য এবারও ঢাকা থেকে এসেছেন একদল চারুকলা শিল্পী। তাঁরাই দিনরাত খেটে তৈরি করেছেন মুখোশসহ নানা লোকজ প্রতীক আর চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যের নানা প্রতীক।
রোববার কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, দিল্লি, বিহার, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, উত্তর প্রদেশ, মেঘালয়, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষীরা বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করে। স্বাগত জানায় বাংলা ১৪২৫ সালকে।