পুতিনের হাতে সুনামি তৈরির অস্ত্র

পুতিনের হাতে থাকা পারমাণবিক সাবমেরিনের বিস্ফোরণে এমন অবস্থা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবি: বিজনেস ইনসাইডার
পুতিনের হাতে থাকা পারমাণবিক সাবমেরিনের বিস্ফোরণে এমন অবস্থা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবি: বিজনেস ইনসাইডার

নামেই সাবমেরিন। কাজে পারমাণবিক বোমা। সাগরের তলদেশে বিস্ফোরিত হলে প্রায় ৩২৮ ফুট উঁচু সুনামি তৈরি করতে পারে, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা আর তেজস্ক্রিয়তা শুধু একটি দেশ নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। রাশিয়া এমনই একটি সাবমেরিন তৈরি করছে। নাম পুজেইদন বা স্ট্যাটাস-৬।

গত ১ মার্চ ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, তাঁরা একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছেন। এটি আদতে একটি সাবমেরিন। অনেকেই রাশিয়ার পারমাণবিক এ সাবমেরিনটিকে পৃথিবী ধ্বংসের যন্ত্র নামেও ডাকছেন। তবে বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, পুতিনের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র আসলেই কি এতটা ভয়ংকর?

ক্রেমলিনের দেওয়া তথ্যমতে, ওই দিন সাবমেরিনটির কার্যক্ষমতার বর্ণনা দিয়েছেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘ড্রোনটি সাগরের “অনেক গভীরে” যাবে। এটি সাবমেরিন অথবা নৌকার চেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটবে। দ্রুতগতির এই ডুবোজাহাজ আন্তমহাদেশীয় হামলা চালাতে সক্ষম। সমুদ্রের গভীর থেকে অতি উচ্চগতির যুদ্ধজাহাজসহ সমুদ্র উপকূলের যেকোনো স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেবে। শত্রুরা তা বাধা দিতে পারবে না। এটি পারমাণবিক অস্ত্র বহন করবে। এটা সত্যিই অসাধারণ।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘মনুষ্যহীন সাবমেরিন প্রচলিত পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে, যা বিমানঘাঁটি, উপকূলবর্তী দুর্গ, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।’ তিনি বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত ইঞ্জিনের পরীক্ষা শেষ করেছে।

১ মার্চ রাশিয়ার ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির কথা বলেন। পারমাণবিক এ সাবমেরিনকে অনেকেই পৃথিবী ধ্বংসের যন্ত্র নামেও অবহিত করছেন। ছবি: রয়টার্স
১ মার্চ রাশিয়ার ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির কথা বলেন। পারমাণবিক এ সাবমেরিনকে অনেকেই পৃথিবী ধ্বংসের যন্ত্র নামেও অবহিত করছেন। ছবি: রয়টার্স

ব্রিটিশ দ্য সানের খবরে বলা হয়, পুতিন ডিভাইসটির নাম বলেননি। তবে এটিকে সমুদ্রতলের বহুমুখী সিস্টেম স্ট্যাটাস-সিক্স মনে করা হচ্ছে, যা কেনিয়ন বা পুতিনের ‘পৃথিবী ধ্বংসের অস্ত্র’ নামেও পরিচিতি পাচ্ছে।

২০১৫ সালে এমন একটি পারমাণবিক সাবমেরিনের ছবি ফাঁস হয়েছিল। তখন সামরিক বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন, পানির নিচে নিঃশব্দে চলাচলকারী এ সাবমেরিন ৫০ মেগাটনের পারমাণবিক বোমা বহন করতে পারে।

পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী বলছেন, এটি সুনামি সৃষ্টি করতে পারবে। যদিও তাঁরা এর উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ভয়ংকর এ পারমাণবিক ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্রটির বিস্ফোরণ ঘটলেই বিপদ।

পুতিনের এই অস্ত্র কেন ভয়ানক
পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণার জন্য নামকরা পদার্থবিদ রিক্স রিচার্ডসন ‘বিজনেস ইনসাইডার’কে বলেন, পুতিনের এই পারমাণবিক সাবমেরিন বিস্ফোরণে সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারবে। আর এ সুনামির কারণে ঢেউয়ের উচ্চতা ১০০ মিটার (৩২৮ ফুট) পর্যন্ত হবে। ওই সুনামি ২০১১ সালের জাপানের সুনামির চেয়েও ভয়াবহ হবে। জাপানে ২০১১ সালে ভূমিকম্প ও পরে সুনামিতে ১৫ হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিল।

রিচার্ডসন আরও বলেন, এই সুনামি তৈরি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস এবং সান দিয়াগো হুমকির মুখে পড়বে। রিচার্ডসন নিজেই সান দিয়াগোতে থাকেন।

লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ পদার্থবিদ গ্রেগ স্প্রিগস বলেন, ৫০ মেগাটন অস্ত্র মানে ‘সম্ভবত সুনামি তৈরি করতে পারে এমন’। এবং ৬৫০ কিলোটন বিস্ফোরণে সমতুল্য শক্তি নিয়ে এটি আঘাত হানতে পারে। কিন্তু তিনি বলেন, ‘এটি অর্থহীন অপব্যয় হতে পারে তবে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র।’

আর এ কারণে গ্রেগ স্প্রিগসের বিশ্বাস যে এই সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ হলে সুনামি হবে।

এর আগে গ্রেগ স্প্রিগস বিজনেস ইনসাইডারকে বলেছিলেন, বড় পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তির তুলনায় ছোটর অস্ত্রের কারণেও স্বাভাবিক সুনামি হতে পারে। তাই পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণের ফলে তৈরি সুনামি খুব বড় ক্ষতির কারণ হবে না।’

পুতিনের পারমাণবিক সাবমেরিন বিস্ফোরণে সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারবে। আর সুনামির কারণে ঢেউয়ের উচ্চতা ১০০ মিটার (৩২৮ ফিট) পর্যন্ত হবে। ওই সুনামি ২০১১ সালের জাপানের সুনামির চেয়েও ভয়াবহ হবে। ছবি: স্কাই নিউজ
পুতিনের পারমাণবিক সাবমেরিন বিস্ফোরণে সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারবে। আর সুনামির কারণে ঢেউয়ের উচ্চতা ১০০ মিটার (৩২৮ ফিট) পর্যন্ত হবে। ওই সুনামি ২০১১ সালের জাপানের সুনামির চেয়েও ভয়াবহ হবে। ছবি: স্কাই নিউজ

তার এই বক্তব্যর সমর্থনে উদাহরণ হিসেবে স্প্রিগস বলেন, ২০১১ সালে জাপানে সুনামির কারণে ৯৩ লাখ মেগাটন পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ছড়িয়ে পড়ার পরিমাণ ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। এ ছাড়া ১৯৬১ সালের ৩০ অক্টোবরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পরীক্ষা করা টিজার বোম্বার চেয়ে ২০১১ সালে সুনামির ফলে জাপানে ছড়িয়ে পড়া পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ১ লাখ ৬৩ হাজার গুণ বেশি।

স্প্রিগস আরও বলেন, এটি বিস্ফোরিত হলে এর নির্দেশনা সাগরের তীরের দিকে হবে না। এটার অধিকাংশই আবার ‘সমুদ্রে ফিরে গিয়ে অপচয় হবে’। তিনি বলেন, এমন পারমাণবিক অস্ত্র যদি উপকূলীয় শহরের দোরগোড়ায় থাকে, তবে এর উদ্দেশ্য অবশ্যই সন্দেহজনক।

এ অস্ত্রের অস্তিত্ব কি আদৌ আছে?
স্ট্যাটাস-সিক্সের অস্তিত্বের ব্যাপারে পুতিন কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলেননি। যদিও গত বছরের ডিসেম্বরে এর পরীক্ষার কথা জানিয়ে পুতিন বলেন, ‘এটি একটি নতুন ধরনের কৌশলগত অস্ত্র তৈরির শুরু।’

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক পারমাণবিক অস্ত্রের পর্যালোচনায় এমন অস্ত্রের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে।

দ্রুতগতির ডুবোজাহাজ আন্তমহাদেশীয় হামলা চালাতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
দ্রুতগতির ডুবোজাহাজ আন্তমহাদেশীয় হামলা চালাতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

মিডলবারি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পারমাণবিক নীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জেফরি লুইস ২০১৫ সালে ফরেন পলিসিতে লেখা এক নিবন্ধে রাশিয়ার এই পারমাণবিক সাবমেরিনটিকে ‘পুতিনের পৃথিবী ধ্বংসের অস্ত্র’ বলে অভিহিত করেন।

ঘণ্টায় ৫৬ নটিক্যাল মাইল গতিসম্পন্ন পুতিনের সাবমেরিনটি ৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম। সম্প্রতি রাশিয়া বেশ কিছু মারাত্মক বিধ্বংসী অস্ত্র ও বোমা তৈরি করছে। এসব অস্ত্রের প্রতিটি পুরো বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

দ্য সান ও বিজনেস ইনসাইডার অবলম্বনে