কর্ণাটকে কী করবেন বিজেপির রাজ্যপাল

কর্ণাটকের রাজ্যপাল বাজুভাই বালা। ছবি: সংগৃহীত
কর্ণাটকের রাজ্যপাল বাজুভাই বালা। ছবি: সংগৃহীত

কর্ণাটকের রাজ্যপালের বয়স ৮০ বছর। তার মানে জীবনটা তিনি অনেক ঘেঁটেঘুঁটে দেখেছেন। তাঁর নাম বাজুভাই বালা। সাকিন গুজরাট। ছোট থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আদর্শে লালিত ও পালিত। কেশুভাই প্যাটেল যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, তখন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য। ২০০১ সালে রাজ্যে পালাবদলের সময় তিনি রাজকোটে নিজের আসনটা নরেন্দ্রভাই মোদির জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম মোদির বিধায়ক হওয়া এবং মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ। তার পর বাজুভাই ফের মোদি-মন্ত্রিসভায় ফিরে এসেছিলেন। এখন রাজ্যপাল।

এমন একজনের পক্ষে কি কর্ণাটকে বিজেপি নেতা ইয়েদুরাপ্পাকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে কংগ্রেস-জেডি (এস) জোটকে ডাকা সম্ভব? বিশেষ করে আজকের এই তীব্র রাজনৈতিক ভাগাভাগির যুগে?

ভোটের ফল বেরোনোর পর কর্ণাটকের বিধানসভার ছবিটা এই রকম: ২২৪ আসন বিশিষ্ট বিধানসভায় ভোট হয়েছে ২২২টিতে। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১০৪, কংগ্রেস ৭৮, জেডি(এস) ৩৭, বিএসপি ১, স্বতন্ত্র ২। ফল বেরোনোর পরপরই সরকার গড়তে কংগ্রেস নিঃশর্ত সমর্থনের চিঠি পাঠিয়ে দেয় জেডি(এস) নেতা এইচ ডি কুমারস্বামীকে। সমর্থন জানায় বিএসপিও। জেডি(এস)-এর সঙ্গে তারা ভোটের আগেই জোট বাঁধে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার ছেলে এই কুমারস্বামী। এর আগেও তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। অতএব রাজ্য শাসনের অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, তিন দলের সম্মিলিত আসন হচ্ছে ১১৬, সরকার গড়ার জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। কী করে এই দাবি অস্বীকার করবেন রাজ্যপাল?

এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর কারও কাছে নেই। কারণ, ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় (কিংবা লোকসভাতেও) সরকার গড়তে রাজ্যপাল (লোকসভার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি) কোন পদক্ষেপ নেবেন, ভারতীয় সংবিধানে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। রাজ্যপাল অথবা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এবং তা আদালতের বিচার্য নয়।

রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালদের নিযুক্ত করে কেন্দ্রের শাসক দল। অধিকাংশই রাজনৈতিক। প্রায় এক শ ভাগ প্রবীণ দলীয় নেতা। কাজেই তাঁরা সব সময়েই অনুগত। এই নিয়ে শুরু কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ঠিক কী রকম হওয়া উচিত এ নিয়ে অনেক আন্দোলনের পর ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ১৯৮৩ সালে বিচারপতি আর এস সারকারিয়াকে চেয়ারম্যান করে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের সুচিন্তিত সুপারিশ ছিল, ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় রাজ্যপালকে দেখতে হবে ভোটের আগে কোনো জোট গঠন হয়েছিল কি না। হলে সেই জোটের যদি গরিষ্ঠতা থাকে তা হলে তাদের সরকার গড়ার প্রথম সুযোগ দিতে হবে। তেমন জোট না থাকলে একক গরিষ্ঠ দলকে সুযোগ দিতে হবে। রাজ্যপাল যদি দেখেন একক গরিষ্ঠ দলের পক্ষেও স্থায়ী সরকার গড়া সম্ভব নয় তা হলে ভোট-পরবর্তী জোট গঠিত হলে কিংবা সমর্থনের চিঠি থাকলে সুযোগ দিতে হবে তাদের। তাতেও সরকার গঠন না হলে রাষ্ট্রপতি শাসন।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম পঞ্ছির নেতৃত্বে ২০০৭ সালে আরও এক কমিশন গঠিত হয়। সারকারিয়া কমিশনের ধাঁচেই পঞ্ছি কমিশন জানায়, ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় সরকার গড়তে ভোট-পূর্ববর্তী জোটকে প্রথম সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। সেই জোটের গরিষ্ঠতা না থাকলে একক গরিষ্ঠ দল সুযোগ পাবে, তার পর দেখতে হবে ভোট-পরবর্তী জোটের দাবি।

দুই কমিশনের এই সুপারিশ যে সবাই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তা নয়। পর পর দুবার, ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে, লোকসভায় কোনো দল গরিষ্ঠতা পায়নি। রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরামন কিন্তু দু বারই একই নিয়ম পালন করেছেন। তিনি ছিলেন ‘টেক্সট বুক প্রেসিডেন্ট’। ১৯৮৯ সালে একক গরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সরকার গড়ার সুযোগ তিনি দেন কংগ্রেসকে। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৯৩ আসন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে রাজীব বলেন, জনতার রায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। সরকার গড়তে তাই তিনি আগ্রহী নন। কংগ্রেস রাজি না হওয়ায় ভেঙ্কটরামন ডাকেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে। দ্বিতীয় গরিষ্ঠ ছিল তাঁর তৈরি জনতা দল। বিশ্বনাথ প্রতাপ সরকার গড়লেন বিজেপি ও বামপন্থীদের সমর্থনে। সেই সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে ভোট হলো। সেবারও কংগ্রেস একক গরিষ্ঠ দল হয়। নেতা নরসিংহ রাওকে সরকার গড়ার সুযোগ দেন ভেঙ্কটরামন। সংখ্যালঘু সরকার গড়লেও আস্থা ভোটে জিতে পাক্কা পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন নরসিংহ রাও।

ভেঙ্কটরামনের উত্তরাধিকারী ছিলেন শঙ্করদয়াল শর্মা। ১৯৯৬ সালে ত্রিশঙ্কু লোকসভায় একক গরিষ্ঠ দল হয় বিজেপি। ১৯৪ সদস্য তাদের। শঙ্করদয়াল শর্মা তাঁর পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকার গড়ার আহ্বান জানান অটল বিহারি বাজপেয়িকে। সেই সরকারের পতন ঘটে তেরো দিন পর। তার পর শুরু হয় কংগ্রেসের সমর্থনে প্রথমে দেবেগৌড়া ও তারপর ইন্দ্র কুমার গুজরালের শাসন। দু বছর পর ফের ভোট হয়। ১৯৯৮ সালে। ফের ত্রিশঙ্কু লোকসভা। কংগ্রেস সরকার গড়ার দাবি না জানালেও রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাজপেয়ির সমর্থনের চিঠি দেখেন। গরিষ্ঠতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে সরকার গড়তে বলেন বাজপেয়িকে। ২০০৪ সালের ভোটে কংগ্রেসের ভোট-পূর্ববর্তী জোট ইউপিএর সংখ্যা বিজেপির জোট এনডিএ-র চেয়ে বেশি থাকায় সুযোগ পায় তারা। কংগ্রেসের জোটকে সরকার গড়ার সুযোগ দেন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম।

ছবিটা পাল্টাতে থাকে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি দিল্লিতে একক দক্ষতায় ক্ষমতা দখলের পর থেকে। একটার পর একটা রাজ্য দখলের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি রাজ্যপাল হিসেবে নিয়োগ করতে থাকে তাদের দলীয় অনুগতদের। এর ফলও তারা পেয়ে চলেছে। গত বছর গোয়া ও মণিপুর বিধানসভার ভোটে কংগ্রেস একক গরিষ্ঠ দল হলেও রাজ্যপালেরা তাদের সরকার গড়ার সুযোগ দেননি। গোয়ায় ৪০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৭, বিজেপি ১৩। কিন্তু অন্যদের সমর্থন নিয়ে বিজেপি সরকার গড়ে রাজ্যপাল তাদের সুযোগ দেওয়ায়। মণিপুরের ৬০ আসনে কংগ্রেস পেয়েছিল ২৮, বিজেপি ২১। কিন্তু অন্যদের সমর্থনের চিঠি নিয়ে সরকার গড়ে তারাই। এই বছর মেঘালয়ের ভোটে ৬০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ২১ টি, বিজেপি মাত্র ২ টি। কিন্তু দ্বিতীয় গরিষ্ঠ দল এনপিপিকে সামনে রেখে বিজেপি বকলমে সেখানে সরকার গড়ে দেয় ভোটের পর অন্যদের সমর্থনের চিঠি রাজ্যপালের কাছে জমা দিয়ে।

ভারতীয় রাজনীতির পরিহাসের বিষয় এটাই যে, তিন রাজ্যের কোথাও বিজেপির রাজ্যপাল একক গরিষ্ঠ দলের দাবি মানেননি। ভোট পরবর্তী জোট গঠন কিংবা সমর্থনের চিঠিকে গুরুত্ব দিয়েছেন সরকার গড়ার ক্ষেত্রে। সেই নীতি মানলে কর্ণাটকের রাজ্যপাল বাজুভাই বালাকেও কংগ্রেস-জেডি(এস) জোটের নেতা কুমারস্বামীকে সরকার গড়ার সুযোগ দিতে হয়। কারণ গরিষ্ঠতা তাদেরই। কিন্তু সেই সুযোগ তারা পাবে কি? কোটি টাকার প্রশ্ন এটাই। বিজেপির একান্ত অনুগত রাজ্যপাল বাজুভাই বালা কি অতটা সাহসী হতে পারবেন? কিংবা অতখানি উদার?