সিরিয়ায় এক মায়ের ছেলেকে ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ের গল্প

সিরিয়ায় এমন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে কত মানুষের স্বপ্ন। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ায় এমন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে কত মানুষের স্বপ্ন। ছবি: রয়টার্স

অস্ত্রের ঝনঝনানি, বারুদের গন্ধ আর ধ্বংসস্তূপে কত শত মানুষের স্বপ্ন যে চাপা পড়ে! কত শত আর্তনাদ যে পাক খেয়ে বেড়ায়! কত শত পরিবার নিঃস্ব হয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য ছুটে বেড়ায় এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। সিরিয়ায় যুদ্ধ যত দীর্ঘ হচ্ছে, ততই বাড়ছে এমন মানুষের সংখ্যা।

২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গেছে। সিরিয়া সেনা ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের হাতে সেখানের মানুষ মারা যাচ্ছে বা বন্দী হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠীও। কারও স্বামী নেই, কারও সন্তান নেই, কারও স্ত্রী নেই, কেউবা বাবা-মা, ভাইবোন হারানো—এমন হাজারো গল্প ধ্বংসস্তূপের নিচে গুমরে মরছে। কোনো কোনো পরিবারের কেউ একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। এমন নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা হাজার হাজার। নিখোঁজ সদস্যের অপেক্ষায় দিন কাটে পরিবারগুলোর। আবার এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে লড়াই করেন একাকী মা। একা চলার এই কঠিন পথ নানা প্রতিবন্ধকতা এসে আটকে দিতে চায়, ক্লান্তি এসে ভর করে; তারপরও অনেকে ছুটে চলেন শুধু সন্তানদের দিকে তাকিয়ে।

তেমনই এক মা ওম মোহাম্মেদ। যাঁর জীবনের গল্প উঠে এসেছে ব্রিটেনর দ্য ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে। যুদ্ধের কারণে স্বামীকে হারান ওম মোহাম্মেদ। ছয় সন্তান নিয়ে জীবনসংগ্রামে নিখোঁজ হয় বড় ছেলে। এরপর থেকে শুধু ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য কঠিন লড়াইয়ে নামেন এই মা। কখনো হাল ছাড়েননি।

ওম মোহাম্মেদের বাবা ছিলেন একজন সফল কৃষক। সুতা ও গম উৎপাদন করতেন তিনি। সিরিয়ার ছোট্ট একটি গ্রামে তিন ভাইবোন নিয়ে ছিল তাঁদের সংসার। মায়ের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে ১৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামী ছিলেন চাকরিজীবী। বিয়ের পর দামেস্কের শাম এলাকায় সংসার পাতেন। সিরিয়ায় সংঘাত শুরুর আগে ১৭ বছর সেখানেই ছিলেন তিনি। যুদ্ধের মধ্যে স্বামীর কাজ কমতে থাকে, অব্যাহত বোমা হামলার ঘটনায় মেয়েদের কাজে পাঠানোও বন্ধ করে দেন।

একদিন স্বামী বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। তিনি ফোনও ধরছিলেন না। স্বামী যেখানে কাজ করতেন, তার কাছাকাছি একটি গ্যারেজে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। স্বামীকে খুঁজতে প্রায় দুই মাস ধরে থানা ও হাসপাতালগুলোয় ঘুরতে থাকেন। এমনকি তাঁরা হাসপাতালের মর্গেও খোঁজ করেন।

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘স্বামীকে খুঁজতে ১০টি হাসপাতালে গিয়ে কত যে লাশ দেখলাম! কত লোক যে আমার চারপাশে মারা পড়ছিল! একদিন এক হাসপাতালের বেসমেন্ট রাখা সারি সারি লাশের মধ্যে খুঁজে পেলাম আমার স্বামীকে। সঙ্গে সঙ্গে আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম।’

২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ায় যুদ্ধে মারা গেছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। ছবি: রয়টার্স
২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ায় যুদ্ধে মারা গেছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। ছবি: রয়টার্স

স্বামীকে খুঁজে ফেরার এই সময়ে ওম মোহাম্মেদের কিশোরবয়সী বড় ছেলে আরান তাঁর সঙ্গে ছিল না। সে বাড়ি থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরত্বে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করত। বাবার লাশ পাওয়া সম্পর্কে সে কিছুই জানত না। তাকে যখন এটা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওম মোহাম্মেদ, ঠিক তখনই আবারও দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে।

আরান যে রেস্তোরাঁয় কাজ করত, ওই সময় সেখানে একদিন আইএসের লোকজন এসে দুপুরের খাবার খায়। এ খবর সরকারি বাহিনীর কানে পৌঁছালে তারা সেখানে হাজির হয়। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। ওই সময় কেউ মারা যায়, কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। আর কেউ কেউ আরানের মতো সেখানে আটকা পড়ে। সেখান থেকে আরানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় সরকারি বাহিনী। আরান জানিয়েছিল, এ ঘটনায় তার কোনো দোষ নেই। সে রেস্তোরাঁয় শুধু চাকরি করে। কিন্তু সরকারি বাহিনীর দাবি ছিল, ওই রেস্তোরাঁর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকলে সেখানে আইএসের লোকজন খাবার খেতে আসত না। এই রেস্তোরাঁর লোকজনের নিশ্চয় আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

এরপর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় ওম মোহাম্মেদের নতুন সংগ্রাম। ওম মোহাম্মেদের ভাষায়, তারা আরানকে বন্দী করে, তুমুল নির্যাতন চালায়, ঘরের সিলিং থেকে ঝুলিয়ে মারধরও করে।

ওম মোহাম্মেদ ওই সময় দিশেহারা হয়ে পড়েন। ছেলের কাছে পৌঁছানোর কোনো উপায় ছিল না। আরান কোথায় আছে, সেটিও তিনি জানতেন না। ছেলেকে না পাওয়ার অসহায়ত্বে কান্নায় ভেঙে পড়তেন তিনি।

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘দিন যায়, আমি কিছুই করতে পারি না। বুঝলাম, আবারও আমার সঙ্গে একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। আমি আমার ছেলেকেও হারিয়েছি।’

যুদ্ধের ভয়াবহতায় উপার্জন ছিল না, খাবারও কমে এসেছিল। এ অবস্থায় পাঁচ সন্তানকে নিয়ে নিদারুণ কষ্টে পড়েন তিনি। পরে ভাইয়ের পরামর্শে তিনি পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ইরাকের কুর্দিস্তানে চলে যান। সেখানে ঘিঞ্জি পরিবেশে দমিজ ক্যাম্পে বসবাস শুরু করেন। সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীর আধিক্য থাকায় সেটি ‘খুদে সিরিয়া’ হিসেবে পরিচিত।

তবে ওম মোহাম্মেদের ভাই বোনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আরানের খোঁজ পাওয়ার চেষ্টায় থাকবেন। এমনকি মর্গে গিয়েও আরানের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছিলেন।

ক্যাম্পে আসার চার মাস পর ভাইয়ের কাছ থেকে খবর আসে, আরান এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু কোথায় আছে, কেমন আছে তা জানেন না। শুধু জানা গেছে, আরান ফ্রন্ট লাইনে যুদ্ধ করছে।

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘আমার ভাই একজন সামরিক কর্মকর্তার ফোন নম্বর পেয়েছিলেন। এরপর ছেলে কোথায় আছে জানতে কত জায়গায় কত যে ফোন করতে হয়েছে! তিন দিন চেষ্টার পর ছেলে কোন শাখায় কাজ করছে, তা জানতে পারি।’

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘তৃতীয় দিন, রাত আটটায়, সময়টা আমার স্পষ্ট মনে আছে, একজন লোক ফোন ধরেছিলেন। আমি জানতে চাই, আরান তাঁর ব্যাটালিয়নে আছে কি না। তিনি জানান, এই নামটি তিনি শুনেছেন। টেলিফোনের লাইনটা খারাপ ছিল। লোকটির কথা খুবই আস্তে শোনা যাচ্ছিল। তিনি জানান, আরানকে তিনি খুঁজবেন, পেলে একবার ফোনের রিং বাজাবেন এবং আমি যেন ফিরতি ফোন করি।’

দুশ্চিন্তায় অস্থির সময় কাটাতে থাকেন ওম মোহাম্মেদ। তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন, কেউ বাধা দেওয়ার আগেই যেন লোকটি ফোন করেন।

ইরাকের ইরবিলে সিরিয়া শরণার্থী শিবির। ছবি: রয়টার্স
ইরাকের ইরবিলে সিরিয়া শরণার্থী শিবির। ছবি: রয়টার্স

কাঙ্ক্ষিত সেই ফোন আসে। একবার বেজেই থেমে যায়। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা ওম মোহাম্মেদ খেয়াল করেন, তাঁর কাছে ফিরতি ফোন করার কোনো ক্রেডিট নেই, অর্থও নেই সঙ্গে। তিনি কিছু চিনি পুঁটলি বেঁধে কাছেই একটি ছোট দোকানে নিয়ে যান। চিনির বিনিময়ে ফোনের ক্রেডিট পাওয়ার জন্য মিনতি করেন।

শেষ পর্যন্ত ফিরতি ফোনটি করতে পারেন তিনি। লাইনটি খুব খারাপ ছিল। ওপাশ থেকে একসঙ্গে অনেক মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল। এমন আওয়াজের মধ্যেই হৃদয় শান্ত হয়ে আসা কণ্ঠটি তিনি শুনতে পেলেন। কেউ একজন বলে উঠল, ‘আমার মা, আমার প্রাণ’—তাঁর ছেলে তাঁকে যা সব সময় বলত।

ওম মোহাম্মেদের ভাষায়, ‘আমার মা, আমার প্রাণ—এটা শুনেই আমি বুঝলাম, আমার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি। ছেলে সঙ্গে সঙ্গেই বাবার কথা জানতে চাইল। কিন্তু তাকে কিছুতেই সত্য কথাটি বলতে পারলাম না। কিছুতেই বলতে পারলাম না যে তোমার বাবা আর বেঁচে নেই।’

এরপর যতবার কথা হয়েছে, আরান বাবার কথা জানতে চেয়েছে, ততবারই মা তার কাছ থেকে সত্য লুকিয়েছেন। আরান মাকে নিজের প্রতি যত্ন নিতে বলত আর ভাইবোনদের দেখে রাখতে বলত।

ছেলেকে নিজের কাছে পেতে এমন কোনো চেষ্টা নেই, যা ওম মোহাম্মেদ করেননি।

এক বছর নয় মাস পর ক্যাম্প ছেড়ে পরিবারটি একটি ছোট বাড়িতে ওঠে। পরিবারটি বাংলাদেশি মুদ্রামানে প্রায় দেড় লাখ টাকা জমাতে সক্ষম হয়। সিরিয়া থেকে ছেলেকে চোরাই পথে বের করে আনার জন্য এই অর্থ ছিল যথেষ্ট।

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘এক লোককে আমরা এই অর্থ দিই। তিনি সিরিয়া থেকে ইরাকের ইরবিলে আমার ছেলেকে নিয়ে আসবে। যুদ্ধে আরানের হাত ভেঙে গেছে, হাতটি আবার জোড়া লাগানো হয়েছে। তাই আরানকে খুঁজে পেতে সহজ হবে। হাত ভাঙার কারণে আরানকে সামরিক এলাকা থেকে বের করে সাধারণ লোকজনের এলাকায় রাখা হয়েছে। এ কারণেই তাঁকে বের করে আনা সম্ভব হবে এবং আমরা তা পেরেছি।’

চোরাই পথে আরানকে ইরবিলে নিয়ে আসার পর পুরো পরিবার সেখানেই একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করে। পাঁচ বছর ধরে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে থাকছেন ওম মোহাম্মেদ।

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘আমি একটি সেলাই মেশিন কিনে নিই। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের কাপড় সেলাই করি। আমার ছেলে পার্কে চা বিক্রি করে। আমাদের জীবন অনেক কঠিন। কিন্তু এরপরও শান্তি যে আমার ছেলে আমার সঙ্গেই আছে। সে আমার কাছে ফিরে এসেছে।’

ওম মোহাম্মেদ এখন উইমেন ফর উইমেন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন। বিশ্বের বিপজ্জনক স্থানগুলোতে বাস করা নারীদের সহায়তা করেন। তাঁদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান দেন। ভোটের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দেন। এই সবকিছু নিজের সন্তানদেরও শেখান তিনি।

ওম মোহাম্মেদ বলেন, ‘আমি যেসব অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি, সেসবের মধ্য দিয়ে যাওয়া নারীদের একটা বার্তাই দিই: উঠে দাঁড়াতে হবে, সামনে চলতে হবে। সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমি খুবই খুশি যে ছেলেকে আবার ফিরে পেয়েছি।’