মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল উপরাজ্যপালের বাসভবনে ধরনায় ছয় দিন

দিল্লির উপরাজ্যপাল অনিল বাইজালের বাসভবনের অতিথিগৃহে ছয় দিন ধরে অবস্থান করছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালসহ অন্য আন্দোলনকারীরা। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
দিল্লির উপরাজ্যপাল অনিল বাইজালের বাসভবনের অতিথিগৃহে ছয় দিন ধরে অবস্থান করছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালসহ অন্য আন্দোলনকারীরা। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

অদ্ভুত এক প্রতিবাদ-আন্দোলন চলছে রাজধানী দিল্লিতে। দেশের চার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও নৈতিক সমর্থন নিয়ে শামিল হয়েছেন সেই আন্দোলনে। অথচ অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর বিন্দু এখনো দৃশ্যমান নয়।

আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল স্বয়ং। সঙ্গী তাঁরই মন্ত্রিসভার আরও তিন সদস্য। দিল্লির উপরাজ্যপাল অনিল বাইজালের বাসভবনের অতিথিগৃহে তাঁরা ছয় দিন ধরে অবস্থান করছেন। অতিথিগৃহের সোফা তাঁদের শোয়া-বসার স্থান। সেখান থেকেই তাঁরা সরকার চালাচ্ছেন। কোনো এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা এমন অদ্ভুত রকমের অবস্থান ধর্মঘট করছেন, ভারতের ইতিহাসে তা কখনো দেখা যায়নি। সেই নিরিখে এই ধরনা অভূতপূর্ব তো বটেই, বিস্ময়করও।

কী অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর? সেও চমকপ্রদ। তাঁর অভিযোগ তাঁরই ‘রাজ্যের’ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। ওই কর্মকর্তারা সবাই ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেসের। অর্থাৎ আইএএস। সরকারি হুকুম ও নির্দেশ পালন করাই যাঁদের ধর্ম। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, এই কর্মকর্তারা সরকারের কোনো নির্দেশ মানছেন না। কোনো সরকারি বৈঠকেও আসছেন না। ফলে রাজ্যের উন্নয়নের কাজ, জনহিতকর কাজ থমকে রয়েছে। কর্মকর্তাদের এই অসহযোগিতা কেন? কারণ, উপরাজ্যপাল নাকি তাঁদের তেমন আচরণের নির্দেশ দিচ্ছেন। উপরাজ্যপাল কেন ওই নির্দেশ দিচ্ছেন? দিচ্ছেন, কারণ, তাঁকে নাকি তেমন আচরণ করতে বলছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্র নাকি চায় জনগণের কাছে রাজ্য সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করতে। অপদস্থ করে তুলতে।

কেন্দ্রের সঙ্গে দিল্লি রাজ্য সরকারের এই লড়াই আজকের নয়। যেদিন থেকে বিজেপি ও কংগ্রেসকে হারিয়ে আম আদমি পার্টি (আপ) দিল্লি দখল করে, লড়াইয়ের শুরুও সেই দিন থেকে। এই লড়াই যতটা পায়ে পা লাগিয়ে, ঠিক ততটাই সংবিধানের দৌলতে। সংবিধান অনুযায়ী দিল্লি ‘রাজ্য’। এই রাজ্যে ৬০ সদস্যের এক বিধানসভা আছে। নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী আছেন। মন্ত্রিসভা রয়েছে। কিন্তু রাজ্য হলেও দিল্লি ‘পূর্ণাঙ্গ’ রাজ্য নয়। দিল্লি যেহেতু ভারতের রাজধানী, সেহেতু পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা কোনো সরকার এখনো তাদের দেয়নি। যদিও কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলই বারবার পূর্ণাঙ্গ রাজ্য গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। সেই দাবি জানিয়ে ‘আপ’ও নির্বাচন জিতেছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রাজ্য আদায় করতে পারেনি আজও। আন্দোলনের আঁতুড়ঘরও এটাই।

পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা না হওয়ায় দিল্লি চলে উপরাজ্যপালের কথায়। অন্যান্য রাজ্যে রাজ্যপাল যেখানে রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী চলেন, দিল্লিতে রাজ্য মন্ত্রিসভা চলে উপরাজ্যপালের কথায়। তা ছাড়া এই দিল্লির জমির অধিকারও মুখ্যমন্ত্রীর নয়। সেই অধিকার কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের। দিল্লির পুলিশও চলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে মুখ্যমন্ত্রীর হুকুম বা নির্দেশ পালনে দিল্লির পুলিশ বাধ্য নয়। মুখ্যমন্ত্রী কোনো কাজে দিল্লির এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণ করতে পারবেন না। অর্থাৎ নামে মুখ্যমন্ত্রী হলেও তিনি ‘নিধিরাম সর্দার’ অথবা ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’।

এমন নয় যে আম আদমি সরকারের শুরু থেকে দিল্লির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমন। এই বৈশিষ্ট্য সেই শুরু থেকেই। অর্থাৎ দিল্লির জমি ও পুলিশের ভার কেন্দ্রের। বিজেপি ও কংগ্রেস যখন দিল্লি শাসন করেছে, সেই সময়ে তারা কেন্দ্রীয় সহযোগিতা যেমন চেয়েছে, তেমন পেয়েছেও। শীলা দীক্ষিত টানা ১৫ বছর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন যখন, কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসি শাসন। কাজেই বিরুদ্ধাচরণের প্রশ্নই ওঠেনি। বিজেপির আমলেও ‘ওয়ার্কিং রিলেশন’ চালু ছিল। কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল ক্ষমতা লাভ করেন প্রথামাফিক রাজনীতি না করেই। শুরু থেকেই নেতিবাচক রাজনীতির তিনি প্রবক্তা। ফলে, ধীরে ধীরে তিনি বাধা পেতে শুরু করেন। তাঁর আমলে উপরাজ্যপালের সঙ্গে যে লড়াই শুরু হয়েছে, ভারতের কোনো রাজ্যে কখনো তা দেখা যায়নি।

এই অবস্থায় চলতি বছর ঘটে যায় আরও এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কেজরিওয়াল রাজ্যের রেশনব্যবস্থা নিয়ে জরুরি এক বৈঠক ডাকেন প্রায় মধ্যরাত্রে। অভিযোগ, সেই বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যসচিব প্রহৃত হন। নিগৃহের অভিযোগ রাজ্যের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগটি আদালতের বিবেচনাধীন। অতএব সত্য-মিথ্যা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, সেই থেকে রাজ্যের আইএএস অফিসারদের একাংশ ধর্মঘট করে চলছে। তারা কোনো বৈঠকে আসছে না। নির্দেশ মানছে না। তাদের এমন অসহযোগ আচরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উপরাজ্যপাল নিজেই এই নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁকে প্রশ্রয় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। এরই প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যরা উপরাজ্যপালের সরকারি গৃহে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। আজ সোমবার সেই অবস্থানের ষষ্ঠ দিন।

দিল্লিতে নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু, কেরালার পিনারাই বিজয়ন ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী ধরনায় থাকা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চান। সেই অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন উপরাজ্যপাল। চার মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টির মীমাংসার জন্য দরবার করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কাছে। মমতা জানান, প্রধানমন্ত্রী মোদি ছিলেন নির্বাক। রাজনাথ বলেছেন, দেখবেন কী করা যায়।

এটা ঠিক, কংগ্রেস ও বিজেপি বারবার পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি ও প্রতিশ্রুতি জানালেও এই লক্ষ্যে তারা এক পা-ও এগোয়নি। এগোবেও না। অথচ সেই দাবি আদায়ের জন্য কেজরিওয়াল ও তাঁর দল প্রাণপাত করছে। এর ফলে দিল্লির প্রশাসন লাটে উঠেছে। সরকার আছে কি না, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রশ্ন। এই অচলাবস্থা ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে, আজকের দিনে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাসঙ্গিক। রাজধানী বলে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা যদি দিল্লিকে দেওয়া না যায়, তাহলে ঘটা করে বিধানসভা রাখার প্রয়োজন কী? কিসেরই-বা প্রয়োজন মুখ্যমন্ত্রীর? যে মুখ্যমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা নেই নিজের অফিসার পছন্দ করার, অফিসারদের বদলি বা নিয়োগ করার, পুলিশকে হুকুম দেওয়ার, সরকারি জমিতে স্কুল বা হাসপাতাল তৈরির, তিনি কিসের মুখ্যমন্ত্রী? এমন মুখ্যমন্ত্রীর কী দরকার, যাঁকে যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য উপরাজ্যপালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়?

দিল্লির বিশেষ চরিত্র নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় কিন্তু এসে গেছে।