ন্যাটো ভাঙনের হাওয়া এশিয়াকে অস্থির করতে পারে

ন্যাটোতে ভাঙনের হাওয়া বইছে।
ন্যাটোতে ভাঙনের হাওয়া বইছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠতে ইউরোপের দরকার ছিল সাহায্য। অন্যদিকে, কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়ার ফুলেফেঁপে ওঠা একা সামলাতে পারত না যুক্তরাষ্ট্র। তাই এই দুই মহাদেশের সামরিক গাঁটছড়া বাঁধতে বেশি দিন সময় লাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা আর পশ্চিম ইউরোপের বেশ কিছু রাষ্ট্র মিলে গড়ে তোলে এই সামরিক জোট, ১৯৪৯ সালে। নাম হয় নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন।

সে সময় বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচাই মূল উদ্দেশ্য ছিল এই সামরিক জোটের। সমুদ্রের ওপারে জোসেফ স্তালিন আহত বাঘের মতো ফুঁসছেন। হিটলারের মহাযুদ্ধের লাভের গুড় পশ্চিমারা খেয়ে গিয়েছে বলেই তাঁর বিশ্বাস। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সোভিয়েত রাশিয়ার পরিসর বাড়াতে আদাজল খেয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে লাল ফৌজ। কাস্তে-হাতুড়ির সঙ্গে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অস্বস্তিকর শান্তিচুক্তি টেকার কথা নয়।

ইউরোপের জন্য প্রশ্নটা ছিল একেবারে টিকে থাকার, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদর্শিক। খোলা বাজার, ভোগবাদ আর বাজার অর্থনীতির মহাপ্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে উল্টো চিত্র সোভিয়েতে। ইউরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তির মানে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ বন্ধুরাষ্ট্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের সামনে রাস্তাটা একেবারেই পরিষ্কার ছিল। এ ছাড়া হিটলারের সঙ্গে স্তালিনের চুক্তির কথা কেউ ভোলেনি। সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি অটল।

সাল ১৯৯১, ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ হয়, সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তি। হিসাবমতে, ভিলেন সোভিয়েতের পতনে পৃথিবীতে শান্তি আসবে। সেটা আসেনি: ইরাক-কুয়েত সংঘাত, সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় জাতিগত সংঘাত আর ব্যাপক বিধ্বংসী সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও অস্থির করে দেয় পৃথিবীকে।

এসব ঘটনায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর ঢল নেমে আসে। নিজের প্রয়োজনেই আবার ন্যাটোকে কাজে লাগায় পশ্চিমা জোট। এত উদ্বাস্তুর ভার নিতে পারবে না দেশগুলো। যেখানে যেখানে গন্ডগোল, সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে ন্যাটো বাহিনী। কসোভোর মুসলমানদের সহায়তায় এগিয়ে যায় ন্যাটো, ১৯৯৯ সালে।

পশ্চিমা জোট বুঝে যায়, নিজের ঘর ঠিক রাখতে হলেও সারা পৃথিবীতে আসলে স্থিতিশীলতা দরকার। সে জন্যই গত শতাব্দীর শেষে খোলনলচে বদলে ফেলে ন্যাটো। নিজেদের সদস্যদের মধ্যে সামগ্রিক প্রতিরক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন আলোচনা, ঘোলাটে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া, সর্বোপরি নতুন স্বাধীন হওয়া দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেয় তারা।

এসবের পেছনে একেবারে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছিল, ব্যাপারটা তেমন নয়। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশ বৈশ্বিক খোলা বাজার তথা বিশ্বায়নের একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের কলোনি এক এক করে নিজের রাস্তায় চলে গেছে। সভ্যতা স্রেফ বন্দুকের জোরে আসলে টিকে থাকে না। তার জন্য দরকার বাণিজ্য। বিশ্বায়নে এই সুযোগ বাড়বে। তার জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র, উদারনৈতিক গণতন্ত্র।

ন্যাটো সেই কাজই শুরু করে। ধীরে ধীরে এশিয়া, উত্তর ইউরোপ ইত্যাদি সব ভূখণ্ডের জন্য ন্যাটো ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের সমার্থক হয়ে যায়।

এ ছাড়া সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এটুকু নিশ্চিত হয়, পশ্চিমা জোটের জন্য হুমকি যেকোনো দিক থেকে আসতে পারে। ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের উত্থান, নাইন-ইলেভেন ট্র্যাজেডি—এসবই ন্যাটোর দৃষ্টি ধীরে ধীরে এশিয়ার দিকে সরিয়ে আনে। এই বিপদের মোকাবিলা করতে ন্যাটোর দরকার আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক। আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে আদর্শের দ্বন্দ্ব বেধে গেলেও বিপদ। তাই ন্যাটো সব সময় উদারনৈতিক বাজার অর্থনীতি আর গণতন্ত্রের ডালা নিয়েই হাজির হয়।

চলছিল বেশ ভালোই, কিন্তু পাশার দান উলটে গেছে ২০১৮ সালে এসে। দান নয়, বলা ভালো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাশার খেলার ছকটাই এলোমেলো করে দিয়েছেন। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই খেলায় আর থাকতে অনিচ্ছুক। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, এই ন্যাটো জোট চুষে খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। আমেরিকার ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি তো ছুড়ছেই, নিজের প্রতিশ্রুতিও রাখছে না ইউরোপ। ন্যাটো জোটের ইউরোপীয় সদস্যদের ২০২৪ সালের মধ্যে জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার কথা। সেদিকে তাদের মনোযোগই নেই।

শুধু তা-ই নয়, দ্য ইকোনমিস্ট আরও বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চোখে ইউরোপ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে। পুরো ইউরোপ আর ন্যাটো মিলে ষড়যন্ত্র করছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। এবার তিনি কোম্পানির সিইওর মতো সবাইকে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। হয় পাওনা মেটাও, নয়তো বিদেয় হও।

তবে স্রেফ বিদেয় হওয়ার হুমকি দিলেই তো হবে না। ট্রাম্পের আচরণের এমন কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। সব ঘটনাকে শুধু টাকার অঙ্কে বিচার করেন ট্রাম্প। সেটা নিজেকে ভালো বড়লোক প্রমাণের আশা থেকে, নাকি তার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না সেটা কে জানে। তবে ট্রাম্পের আচরণ একজন ঘোড়েল বসের মতোই। ঘটনার পেছনের ঘটনা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই।

ট্রাম্প ভুলে যাচ্ছেন, গত এক যুগের যেসব যুদ্ধে ন্যাটো মাথা ঘামিয়েছে, সেগুলো আসলে যুক্তরাষ্ট্রেরই যুদ্ধ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেটা আমেরিকাই বাধিয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে ন্যাটো পিছপা হয়নি। গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেনডেন্টের বরাত দিয়ে জানা যায়, আফগানিস্তানের পাহাড়ে, ব্রিটিশ এসএএস জওয়ান বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, হেলমান্দ প্রদেশে অস্ট্রেলিয়ান হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়েছে আল-কায়েদার রকেট লঞ্চারের আঘাতে। সেসবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের থোড়াই কেয়ার। উনি ন্যাটোর চুক্তির দাম চান। কড়কড়ে নোটের দাম। না হলে তিনি দাবার বোর্ড উলটে দেবেন।

পুরো ন্যাটো চুক্তি আমাদের প্রাচীন গ্রিসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এথেন্স ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান-সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র। অন্যদিকে, স্পার্টা ছিল যুদ্ধবাজ নগর। দুইয়ের মাঝে চুক্তিটাও সে রকম। গ্রিস আক্রান্ত হলে একেবারে প্রথমেই ময়দানে নেমে রক্ত ঝরানোর দায়িত্ব স্পার্টানদের। এথেনিয়ানরা তার বদলে বাণিজ্যের দিকটা দেখবে, সেবা, চিকিৎসা, দর্শন, সুকুমার বৃত্তি—এসবে নজর দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল এথেনিয়ানরা।

বর্তমানে ন্যাটো দেশগুলোর দিকে তাকালে সেই চিত্রটাই আবার নজরে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ঋণের দায়ে জর্জরিত, সেখানে ইউরোপে ফ্রি টিউশনে ছেলেমেয়েরা পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার খরচ বইতে নাগরিকের প্রাণ ওষ্ঠাগত, সেখানে ইউরোপের সাশ্রয়ী চিকিৎসা পেতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাড়ি জমাচ্ছে লোকে। ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য আর সামরিক চুক্তির ঠিকুজি-কুলুজি সন্ধান না করে হাত-পা ছুড়লে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি বই লাভ হবে না।

এদিকে প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতোই ইউরোপেও এখন গণতন্ত্রকে বোঝা মনে করা নেতার উত্থান ঘটছে। ইতালিতে পুতিনপন্থী নতুন প্রেসিডেন্ট। তুরস্কের এরদোয়ানও কম যাচ্ছেন না। এঁরা সবাই বিরুদ্ধমত, আলোচনা, সমালোচনাকে পিষে দিতেই ভালোবাসেন। উদারনৈতিক গণতন্ত্র নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ট্রাম্পের মতোই হরেদরে ‘দেশ এগিয়ে’ নেবেন তাঁরা। সেটার জন্য যদি বর্ণবাদী পলিসিও নিতে হয়, কুচ পরোয়া নেই।

পশ্চিমা এই জোট ভেঙে যাওয়ার আনন্দে শিকারি বিড়ালের মতো গোঁফে তা দিচ্ছে ক্রেমলিন আর বেইজিং। কারণ, এই বাণিজ্য ও সামরিক চুক্তি ভেঙে গেলেই এশিয়া পড়বে নতুন করে বিপদে। ন্যাটো জোট ভাঙলে আর্থিক লাভ হবে না কারওরই। ইউরোপকে তখন পেনশনে বরাদ্দ কমিয়ে নতুন করে প্রতিরক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমবে। তখন আর ভর্তুকি দিয়ে নতুন বাণিজ্য করার বিলাসিতা হবে না। গ্রিসে পার্সিয়ান আক্রমণের কথাই মনে করে দেখুন, গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোর ঝগড়ার সুযোগ নিয়েই গ্রিসকে প্রায় পোষ মানিয়ে ফেলেছিলেন রাজা জেরেক্সেস। গ্রিস পরে ঐক্যবদ্ধ হলে তবেই রণে ভঙ্গ দেন তিনি।

পশ্চিমা জোটের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যের খাতিরেই নিজদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা জাগিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল এশিয়ায়। হুট করে এখানে তাই কোনো ব্যানানা রিপাবলিকের উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবু ইউরোপ বহুদূর। কূটনীতির খাতিরে সব সময় এশিয়ার রাজনীতিতে নাক গলাবে না তারা। বিশ্বায়নের খোলা বাজার ঠিকমতো চললেই ইউরোপ খুশি। সে ফাঁকেও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছুপা রুস্তমের মতো কদলীতন্ত্র গেড়ে বসেনি তা নয়।

ন্যাটোতে ভাঙনের হাওয়া বইছে, ইউরোপে গোঁয়ার-গোবিন্দ মারকুটে শাসক একের পর এক ছত্রাকের মতো মাথা তুলছে। সেই অবস্থায় এশিয়ার দুশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ন্যাটো কূটনীতি ভালোই বোঝে, মিঠে কথায় কাজ না হলে সময়মতো এআর-১৫ রাইফেলও ঘাড়ে ঝোলে। তাই নির্বাচন, সংবাদপত্রের আপাত স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা থাকে এশিয়ায়। ব্রাসেলসে ন্যাটোর সম্মেলনের দিকে তাই এখন তাকিয়ে পুরো বিশ্ব। এই সম্মেলনের ওপরেই আসলে নির্ভর করছে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ইতিহাস। একই সঙ্গে এশিয়ারও। মারকুটে মেঠো বক্তাদের আনাগোনায় কোথায় হাঁটে এশিয়া, সেটা ব্রাসেলস সম্মেলনের পরেই পরিষ্কার হবে।