হেলসিংকি বৈঠকে ট্রাম্প-পুতিন: নতুন তৈল-জোটের সম্ভাবনা

আগামীকাল সোমবার হেলসিংকিতে বৈঠকে বসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। এএফপি ফাইল ছবি
আগামীকাল সোমবার হেলসিংকিতে বৈঠকে বসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। এএফপি ফাইল ছবি

পশ্চিমে নয়া নয়া মহাশক্তির টানাহেঁচড়া প্রাচীন। হেলেনিক গ্রিসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফিকে করেই রোম সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু করেন সিজার। সেই রোমান সাম্রাজ্যের শুরুর প্রভাব সুদূর মিসরের তৎকালীন রাজনীতিতেও পড়েছিল। এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে পশ্চিমা রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে। হেলসিংকিতে আমেরিকার জন্য সিজারবেশে ভ্লাদিমির পুতিনের আগমনের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনও হতে পারে, রাশিয়া, আমেরিকা আর ইউরোপের ত্রিপক্ষীয় সংঘাত। তবে এসবই জল্পনা।

আগামীকাল সোমবার হেলসিংকিতে বসছে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক। সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে এই বৈঠকে দিকে। অনেকেই হয়তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আপাত-বেকুবি আর প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিঃশব্দ কূটনীতির ভানুমতির খেল দেখার অপেক্ষায় আছেন। তবে কূটনীতির শুভংকরের ফাঁকি কী হচ্ছে, তা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘামছে, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

রয়টার্সে প্রকাশ, এই আলোচনা হতে পারে সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে। পুতিন কিছুদিন আগেই বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া দেখিয়েছেন বিশ্বকে। সবাইকে মেনে নিতে বলেছেন নতুন বাস্তবতা। তবে ট্রাম্পও পিছিয়ে নেই। তিনিও বাজির দান বাড়িয়েছেন। বলেছেন, যদি ওয়ারহেড বাড়াতেই হয়, আমেরিকা থাকবে সবার ওপরে। ঠিক যেন মহাভারতের দুর্যোধন, বিনা যুদ্ধে সুচ পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।

নতুন করে আবার পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হলে রাশিয়া ও আমেরিকার দুই দেশেরই টাঁকশাল খালি হয়ে যাবে, এটা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। এটা নতুন করে সারা দুনিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রদৌড়ও শুরু করতে পারে।

ট্রাম্প সব সময় দাবি করে থাকেন, দুনিয়ায় তাঁর চেয়ে চতুর কেউ নেই। প্রমাণ? কেন, বাবার কাছ থেকে এক কোটি ডলার ধার নিয়ে নিজেকে বিশাল ধনী বানিয়েছেন। সেটা আরও ভালো করে যাচাইয়ের কষ্টিপাথর হেলসিংকিই বটে। ওখানে ভুল করলে আমেরিকার নড়বড়ে অর্থনীতি আবারও তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে পারে। তাতে অবশ্য পুতিনের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। তাঁর দেশে পড়ন্ত অর্থনীতি নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের গুলাগে মিলিয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত প্রবণতা আছে।

পারমাণবিক অস্ত্রের এই খরুচে ইঁদুরদৌড় ঠেকাতেই ওবামা আর মেদভেদেভ ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল নিউ স্টার্ট নামে আরেকটি চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তিমতে, ১ হাজার ৫৫০-এর বেশি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড কেউ রাখতে পারবে না।

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে ২০২১ সালে শেষ হতে যাওয়া এই অস্ত্র চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। তাতে কারওরই আপত্তি থাকার কথা নয়। শ্যাম ও কুল দুই রাখতে পারেন ট্রাম্প ও পুতিন। যতই ধমক দিন, রাজত্ব করতে হলে এই পৃথিবীতেই করতে হবে। দুনিয়ার ধ্বংসস্তূপ সম্রাট আদতে খুবই একাকী।

টাইম সাময়িকীর মতে, ট্রাম্প চাইলে এই সুযোগে রাশিয়াকে চাপ দিয়ে বাশার আল-আসাদের বন্ধুতা থেকে সরিয়ে আনতে পারেন। কারণ, গুপ্তহত্যা, যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ নির্বাচনে নাক গলানো—এসব কারণে রাশিয়ার ওপর মহা খাপ্পা সবাই। এর ফলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আরও শক্ত করার হুমকি কাজ করতে পারে।

নিজেকে কড়া লোক ভাবতে ও ভাবাতে ভালোবাসেন ট্রাম্প। এমন সুযোগ আর পাবেন না তিনি। তাও এককালের দুর্ধর্ষ কেজিবি এজেন্ট পুতিনের সামনে। ডোনাল্ড ট্রাম্প পুতিনকে শুনিয়ে দিতেই পারেন, বাশার আল-আসাদের অপসারণ ও প্রতিস্থাপনের আগে সিরিয়া থেকে নড়ছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ৬৮ রাষ্ট্রের জোট। গুপ্তহত্যাচেষ্টাগুলো না থামালে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কমবে না, সেটাও পুতিনের জানা থাকা দরকার। ওগুলো বন্ধ না করলে তার বদ-প্রভাব রাশিয়ার ওপর পড়বে।

তবে বিবিসির খবর আমাদেরকে অন্য কথা ভাবাচ্ছে। কিছুদিন আগেই ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি লন্ডভন্ড করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফলে, বাজার থেকে ইরানের তেল হাওয়া হয়ে যেতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে তেলের বাজারে সবচেয়ে বড় নাম হয়ে উঠতে পারে ট্রাম্পের আমেরিকার। তখন এই পাল্টাপাল্টি ট্যারিফের যে লড়াই চলছে, সেটাতে যুক্তরাষ্ট্রেরই জয়। পেট্রো-ডলার তখন ঝুঁকে পড়বে আমেরিকার দিকেই।

ঠিক এখানেই পুতিনের রাশিয়ারও বাজিমাত। বিশ্ববাজারে তেলের মজুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঠিক পেছনেই রাশিয়া। রাশিয়ার মজুতে আছে ৮০ হাজার মিলিয়ন ব্যারেল কালো সোনা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক ১০ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন ছিল রাশিয়ায়। ন্যাটোর সঙ্গে গোস্‌সা করে ট্রাম্প যদি এবার রাশিয়ার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধেন, তবে পেট্রো-ডলারের লাগাম থাকবে ট্রাম্প-পুতিন জোটের হাতেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়নেও চলছে বিচ্ছেদের সুর। বিদায় জানিয়েছে ইংল্যান্ড। চৌকাঠে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল সামাজিক কৃচ্ছ্রসাধনের। সে দায় ইউরোপ মিটিয়েছিল ন্যাটো চুক্তির মাধ্যমে।

আমেরিকা তার বাজেটের বিশাল অংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে। তাই আমেরিকার কাঁধে ভর দিয়েই খানিকটা সামরিক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনে মন দিয়েছিল তারা। এখন ট্রাম্পের দাবি মেটাতে হবে। না হলে টুইটারে বারবার হুমকি দিয়েই যাচ্ছেন ট্রাম্প। চুক্তি না মানলে ন্যাটো রেখে লাভ কী? এখন তো দাবিও বাড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। বিবিসির বরাতে জানা যাচ্ছে, ট্রাম্প বলছেন, ইউরোপের জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ সামরিক খাতে দিলে আর কাজ হবে না, ওটা বাড়িয়ে করতে হবে ৪ শতাংশ।

ন্যাটো জোটের এই বিভেদে হয়তো ক্রেমলিনে বসে মুচকি হাসছেন পুতিন। ওদিকে সি চিন পিংও বসে আছেন বলে বিশ্বাস হয় না। কিছুদিন আগেই উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন তিনিও। হয়তো তিনিও ভাবছেন, লাঠিটা কিম জংয়ের হাতে তুলে দিয়ে চীনের কৃচ্ছ্রসাধন অর্থনীতি আরও জোরদার করবেন।

সব মিলিয়ে ২০১৩ সালের পুতিনের থেকে এখনের পুতিনের বিস্তর ফারাক। সেবার ওবামা বলেছিলেন ‘পুতিন একলা হয়ে গেছেন।’ তবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে সেটা আর সত্য নয়। একটু একটু করে ছবিটা বদলেছে। বিশ্বকাপে ফুটবলারদের পায়ের জাদু থেকে ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টি সরিয়ে গ্যালারিতে তাকান। দেখতে পাবেন বিশ্বনেতাদের পাশে বসিয়ে, স্মিতহাসিতে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে পুতিনের রাশিয়া। এককালের কেজিবি ‘গুপ্তচর’ বা ‘গুন্ডা’ শাসকের জন্য মন্দ নয় ব্যাপারটা।

হেলসিংকি বৈঠকেও একটা জয় নিয়েই শুরু করছেন পুতিন। রবার্ট মুলারের বিশেষ তদন্তে এখন পর্যন্ত ১১ জন রাশিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলে হয়েছে। অভিযোগ আমেরিকার ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের গণেশ উলটে দেওয়া।

ট্রাম্পের হেলসিংকি যাত্রা নিয়ে তোলপাড় করেছিল ডেমোক্র্যাটরা। তাতে ট্রাম্পের চিড়ে ভেজেনি। আপাতত মনে হচ্ছে, পুতিনের স্মিতহাসি ছাড়া ভিজবেও না। এখানেই জিতে গেছেন পুতিন, পাঁচ বছরে একাকী থেকে তিনি বিশ্বরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

বিশ্ববাণিজ্য, পেট্রো-ডলার, রাজনৈতিক আদর্শের এক ত্রিমুখী সংঘাতের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব। লড়াইটা যেহেতু অর্থনীতির, আশা করা যাচ্ছে, কোনো নেতাই হয়তো সর্বগ্রাসী যুদ্ধে নামবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো খোলনলচে বদলাবে আন্তর্জাতিক ভরকেন্দ্রের।

শুরু করেছিলাম হেলেনিক সভ্যতার পতনের পর রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব নিয়ে। বিশ্ববাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা যেদিকেই হেলুক, এর সঙ্গে বদলাবে আদর্শের কম্পাস। নতুন খদ্দের ধরতে ছুটবে টালমাটাল অর্থনীতির দেশগুলো, বদলাবে রাজনীতির বোলচাল। এমন সময় দক্ষিণ এশিয়ার উঠতি অর্থনীতিরাও নিশ্চয়ই চোখ রাখছে হেলসিংকি, ব্রাসেলস আর চীনে। না হলে হোঁচট খাওয়ার বিপদ আছে।