হেলসিঙ্কিতে হাসি নেই ট্রাম্প-পুতিনের মুখে

বৈঠকের একটা মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গতকাল ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে।  ছবি: রয়টার্স
বৈঠকের একটা মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গতকাল ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে। ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। কিন্তু সেখানেও হাসি ফুটল না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখে। দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা যেন তাঁদের দুজনের একান্ত বৈঠকেও গিয়ে আছড়ে পড়ল। পরস্পরের সঙ্গে হাত না মিলিয়েই বৈঠককক্ষে প্রবেশ করেন তাঁরা।

বৈঠক শুরুর পর হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যান্ডার্স ট্রাম্প-পুতিনের যে ছবি টুইট করেন, তাতেও দেখা যায় পুতিন নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আর ট্রাম্পকে দেখাচ্ছিল বিমর্ষ, রাগান্বিত। অথচ রাশিয়ার সঙ্গে ‘অসাধারণ সম্পর্কের’ আশাবাদ জানিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ট্রাম্প। দুই ঘণ্টার বেশি সময় একান্তে বৈঠক করার পর তিনি জানান, পুতিনের সঙ্গে আলোচনার ‘শুভসূচনা’ হয়েছে।

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে গতকাল সোমবার দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে দুই নেতার এই ঐতিহাসিক বৈঠক হয়। প্রায় এক দশক পর বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতারা এই প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেন। তা ছাড়া ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গত দেড় বছরে দুই দেশের টানাপোড়েন মাঝেমধ্যেই চরম মাত্রা পাচ্ছে। ট্রাম্পকে নির্বাচিত করতে পুতিনের রাশিয়া মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগের তদন্ত চলছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প-পুতিনের প্রথম একান্ত বৈঠকের দিকে নজর ছিল সারা বিশ্বের। যদিও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সম্মেলন ও অনুষ্ঠানে দুই দেশের নেতাদের বেশ কয়েকবারই সাক্ষাৎ হয়েছে।

বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পুতিনের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে এবং তা বেশ ভালোভাবেই এগিয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবল আসরের আয়োজনের জন্য তিনি এ সময় পুতিনকে অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপ আসরটি আগের যেকোনো আসরের চেয়ে সেরা বলেও অভিহিত করেন তিনি।

ট্রাম্প বলেন, সংঘাত ও বৈরিতা নয়, কূটনীতি আর অংশগ্রহণ চান তিনি। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের কথা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প নিজের দেশেরই বিচার বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা শিবিরের কোনো আঁতাতই হয়নি। বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলার যে তদন্ত করছেন, তা হাস্যকর। এই তদন্ত রুশ-মার্কিন সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা ইস্যুতে পুতিন একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

আর ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে পুতিন বলেন, ‘বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগের বিষয়টি তুলেছেন। আমি আগেও বেশ কয়েকবার বলেছি, রাশিয়া কখনোই হস্তক্ষেপ করেনি এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভবিষ্যতেও কখনো হস্তক্ষেপ করবে না।’

এই পর্যায়ে পুতিনের কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি কি ট্রাম্পের বিজয় চাননি? জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ চেয়েছিলাম। কেননা ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প।’ রুশ প্রেসিডেন্ট জানান, মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের ওই অভিযোগ নিয়ে সন্দেহভাজন রুশদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মস্কোর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন রবার্ট ম্যুলার।

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে পুতিন বলেন, ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই চুক্তির কল্যাণেই ইরান এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত দেশ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্কের ব্যাপারে পুতিন বলেন, এই দুই দেশের সম্পর্কের জটিলতার পেছনে কোনো দৃঢ় কারণই নেই।

এদিকে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকটি ‘চমকপ্রদ’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তবে সংবাদ সম্মেলনে এবং পুতিনের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে ট্রাম্প যা বলেছেন, তা পরিকল্পনার ভেতরে ছিল না বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা। হেলসিঙ্কি সম্মেলনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট এই কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, কথা ছিল পরিকল্পনার বাইরে যাবেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে পুতিনকে কড়াভাবে চেপে ধরার কথাও ছিল তাঁর। সম্মেলনে তাঁর নিজের মতো করে কিছু বলা পরিকল্পনার মধ্যে ছিলই না।

ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন তাঁর নিজের দল রিপাবলিকান পার্টিরই দুই সিনেটর। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা ও মার্কিন সিনেটের আর্মড সার্ভিস কমিটির সদস্য লিন্ডসে গ্রাহাম টুইট করেছেন, রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপস্থাপনা মস্কোকে বার্তা দেবে যে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল। আরেক রিপাবলিকান সিনেটর জেফ ফ্ল্যাক টুইট করেছেন, ট্রাম্পের ভাষা ছিল ‘লজ্জাজনক’।

আর বিরোধী ডেমোক্রেটিক দলের সিনেটর চাক শুমার টুইট করেন, পুতিনের পাশে ট্রাম্পের উপস্থিতির ধরন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে।

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের ফলাফল নিয়ে সংশয় আছে অনেকেরই। এর অন্যতম কারণ, ট্রাম্পের ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন আর ওয়াশিংটন-মস্কো মতপার্থক্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ট্রাম্পের ‘পুতিন-ভক্তি’। বৈঠকের ঘণ্টাখানেক আগেও ট্রাম্পের এক টুইট থেকে ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি ওই টুইটে লেখেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনোই এতটা খারাপ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের বহু বছরের বোকামি আর নির্বুদ্ধিতা এবং চলমান অন্তঃসারশূন্য অনুসন্ধানের জন্যই এমনটা হয়েছে।’

অন্তঃসারশূন্য অনুসন্ধান বলতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের তদন্তকে বোঝান। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ তদন্ত করছেন তিনি। তাঁর এই তদন্তের অংশ হিসেবেই গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে রাশিয়ার ১২ জন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছেন। তবে ট্রাম্প বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা শিবিরের কোনো ধরনের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। শনিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএসকে তিনি বলেন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও চীন তাঁর দেশের শত্রু।