সরে দাঁড়ানোও কখনো কখনো নেতৃত্ব হতে পারে

নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: রয়টার্স
নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: রয়টার্স

নানা অর্থেই নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলার সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে নেতৃত্ব ত্যাগ করা। 

স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি চাইলে সারা জীবন প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যেতে পারতেন। নিঃসন্দেহে বিনা ভোটে দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। কিন্তু তিনি জানতেন, তাঁর আসল কাজ হচ্ছে যেমনটি সিরিল রামাফোসা বলেছেন, ‘দিক স্থির করে দেওয়া, রাষ্ট্রপরিচালনা নয়।’ তাই ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায়, তিনি বলেন ‘১৯৯৯ সালে তাঁর বয়স হবে আশি এবং একজন অশীতিপর বৃদ্ধের রাজনীতিতে নাক গলানো উচিত নয়।’ যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি নির্বাচনে লড়বেন কি না, তিনি জবাব দেন, ‘অবশ্যই না।’ এবং তিনি প্রার্থী হননি। এটা ছিল নেতৃত্বের পরিচয়বহ একটি কাজ।

আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে ম্যান্ডেলাই প্রথম রাজনৈতিক বন্দী নন, যিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। বস্তুত তিনি ছিলেন বিশ শতকের একটি প্রথারই অংশ। কেনিয়ার কেনিয়াট্টা, ঘানার নক্রুমা, জিম্বাবুয়ের মুগাবেও রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। একজন প্রেসিডেন্ট স্বেচ্ছায় শাসনতান্ত্রিকভাবে অথবা জনগণের রায়ে দায়িত্বভার ছেড়েছেন—আফ্রিকায় এমন অভিজ্ঞতা বিরল। বেশির ভাগ বিদায় নেন হয় ইহলোক ত্যাগ করে অথবা একে-৪৭ ব্যারেলের মুখে। ম্যান্ডেলার সমসাময়িক, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে নিজের দেশটাকে ধ্বংস করার পরও এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন।

ম্যান্ডেলা শুধু এটা প্রমাণ করতে চাননি যে আফ্রিকানরা নিজেরা নিজেদের দেশ পরিচালনা করতে পারে, তিনি এটাও দেখাতে চেয়েছিলেন যে আফ্রিকা সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মহাদেশ হয়ে উঠতে পারে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের এক পীঠস্থান। নানা দিক থেকে তিনি ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটনের আফ্রিকান প্রতিচ্ছবি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর স্বেচ্ছায় একজন। তিনি প্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর স্বেচ্ছায় একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনে ফিরে যান। আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার সম্ভাবনা (যার পক্ষে অনেকেই মত দিয়েছিলেন) বর্জন করে তিনি আমেরিকান প্রেসিডেন্সির ছাঁচ তৈরি করে দেন। ওয়াশিংটনের মতো, ম্যান্ডেলাও বুঝতে পেরেছিলেন, বালির ওপর তাঁর প্রথম পদাঙ্কই অন্যেরা অনুসরণ করবেন। তিনি জানতেন, তাঁর নেওয়া অন্য যেকোনো পদক্ষেপের চেয়ে বরং তাঁর নিজের কৃতকর্মের উদাহরণ অনেক বেশি স্থায়ী এবং প্রভাববিস্তারী হবে।

যখন তিনি সত্যিই পদত্যাগ করেন, তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর সত্যিই অবসর নেওয়া উচিত, রোমান নেতা সিনসিনাটাসের মতো হওয়া উচিত তাঁর, যিনি নিজের খামারে ফিরে গিয়ে নিরিবিলি জীবন যাপন করেন। ম্যান্ডেলা অবশ্য একেবারে নিভৃত জীবন চাননি—তিনি তখনো পাদপ্রদীপের আলো ভালোবাসতেন, কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন অথচ মানুষ ভাববে তিনি এখনো প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুপ্ত বাসনা লালন করেন—এটা তিনি করতে পারেন না। মঞ্চ ত্যাগ করার পর আপনি পর্দার পাশ দিয়ে উঁকি দিতে পারেন না। প্রথম কয়েক বছর, তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীর নীতি নিয়ে মন্তব্য না করার ব্যাপারে অটল ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তিনি অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছেন—এখন অন্যদের দায়িত্ব জাহাজটি পরিচালনা করা।

ম্যান্ডেলা জানতেন যে সব বিষয়ে মাথা ঘামাতে নেই, কিছু ক্ষেত্রে নীরব থাকাই সবচেয়ে ভালো। কিছু পরিস্থিতি আছে আমাদের মূলধন রক্ষার জন্য, যেখান থেকে আমরা সরে থাকতে পারি। রোবেন দ্বীপে বন্দীরা একে অপরের সঙ্গে বিরামহীন তর্কে লিপ্ত হতেন। সূর্যের নিচে যেকোনো বিষয় নিয়েই তাঁরা তর্ক করতে পারতেন, কিন্তু গুটিকয়েক নির্দিষ্ট বিষয় ছিল: কমিউনিস্ট পার্টি ও এএনসি একীভূত হবে কি না, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক সরকার আফ্রিকার-প্রধান ন্যাশনাল পার্টিকে অন্তর্ভুক্ত করবে কি না এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় (এবং অবশ্যই সবচেয়ে মজারও) আফ্রিকাই বাঘের আদি আবাসভূমি কি না। বলতে কী, আফ্রিকায় কোনো বাঘ নেই; বাঘ হচ্ছে এশীয় প্রাণী। তবে সময়ে কয়েকজন বন্দী বদ্ধমূল বিশ্বাস করলেন আফ্রিকাই হলো বাঘের আবাস এবং তারা বক্তব্যের পক্ষে আবেগপূর্ণ যুক্তি দেখালেন। বিশেষভাবে একজন কয়েদি এ ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। একদিন ম্যান্ডেলা তাঁকে বললেন যে আফ্রিকায় বাঘ নেই। এ কথায় খেপে গেলেন ওই কয়েদি। কিন্তু ম্যান্ডেলা পাল্টা তর্ক করার বদলে হার স্বীকার করে নিলেন। শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে।’ এবং অপেক্ষায় রইলেন। বেশ কয়েক বছর অপেক্ষার পর এক কয়েদি এলেন, যিনি প্রাণিবিদ্যায় লেখাপড়া করেছিলেন এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আলবত, সেই নতুন আসা কয়েদি বললেন, আফ্রিকা বাঘের আবাসস্থল নয়। তাঁর এ কথায় সবাই বিশ্বাস করল। এমনকি গোঁয়ার কয়েদিও। ম্যান্ডেলা একবারও বড়াই করেননি।

ম্যান্ডেলা সব সময় খুব অনমনীয় স্বভাবের ছিলেন। রোবেন দ্বীপে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ স্ত্রী গ্রাসা ম্যাশেলও এ কথা বলেছেন। ম্যান্ডেলা যখন মনে মনে কোনো কিছু ঠিক করতেন, কারও পক্ষেই তা সম্ভব ছিল না তাঁর সেই ভাবনা পাল্টানো। তবে অবশ্যই তিনি তাঁর মত পাল্টাতেন। বিশেষ করে যখন দেখতেন তাঁর মনোভাব না পাল্টালে নেতিবাচক কিছু হতে পারে। তিনি তাঁর মতের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন এবং প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারতেন যে তাঁর অবস্থান বাস্তবসম্মত নয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষান্ত দিতেন এবং সেখানেই তা শেষ হতো।
একদিন ম্যান্ডেলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের ভোটাধিকার আছে—এমন দেশ সম্পর্কে আমি জানি কি না। তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। দেশটির অর্ধেক মানুষ ১৮ বছরের কম বয়সী। আবার এসব ১৮ বছরের কম বয়সীর বেশির ভাগই কালো মানুষ। এরা সুযোগ পেলে অবশ্যই ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকেই ভোট দেবে।

আমি বিষয়টি নিয়ে ছোটখাটো গবেষণা শুরু করলাম এবং এর একটি তালিকা তাঁর কাছে তুলে ধরলাম। তালিকায় বেশি দেশ পাওয়া ছিল না: কিউবা, নিকারাগুয়া, উত্তর কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ইরান। তবে ম্যান্ডেলা এই হ্রস্ব তালিকা পেয়েও খুশি হলেন। তিনি বললেন, ‘খুব ভালো, খুব ভালো।’ এ ছিল তাঁর সর্বোচ্চ প্রশংসাসূচক বাক্য। দুই সপ্তাহ পর ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ১৪ বছর বয়সীদের ভোটার করার পক্ষে প্রস্তাব দিলেন। তাঁর এ প্রস্তাবে তাঁর নিজ দল এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলো। জনগণ বলাবলি করতে লাগল, এটা ম্যান্ডেলার একেবারে বোকামিপূর্ণ একটা প্রস্তাব। অনেকে এর চেয়ে অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করতে লাগল।

কয়েক সপ্তাহ পর আমি তাঁকে ঠাট্টা করে বললাম যে তাঁর প্রস্তাব যথার্থ সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি। আমার কথা শুনে তিনি ভ্রু কুঁচকালেন এবং মাথাটা পেছন এলিয়ে দিয়ে বললেন তিনিই জিতছেন। শেষ পর্যন্ত বিরোধীরাই বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হন। ‘ধারণাটা তিনি বিক্রি করতে চেষ্টা করেছিলেন,’ স্মৃতিচারণা করেন রামাফ্রোসা, যিনি জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন, ‘কিন্তু তিনি ছিলেন একমাত্র (সমর্থক) এবং তাঁকে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় যে এটি জিতবে না। তিনি বিনয়ের সঙ্গে এটা স্বীকার করে নেন। তিনি মুখ ভার করেননি।’
ম্যান্ডেলা যখন তাঁর পূর্বের অবস্থান পাল্টাতেন, তখন এটা বোঝার উপায়ই থাকত না যে তিনি এর বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি নতুন অবস্থানে দ্রুত সরে আসতেন এবং নতুন ধর্মান্তরিতের উদ্দীপনায় নতুন মতকে গ্রহণ করতেন। একসময় বিরোধিতা করে লড়াই করেছেন, এটা মনে করে তিনি এমনকি হাসবেন। বহু বছর পর, চৌদ্দ বছর বয়সীদের ভোটের প্রসঙ্গ যখনই এসেছে, তিনি আমার উদ্দেশে চোখ মটকেছেন। তিনি বুঝতেন যে হার স্বীকারও একধরনের বিজয় হতে পারে—বুঝতেন যে আত্মসমর্পণের অর্থ আপনি জয়ী পক্ষে যোগ দিচ্ছেন। তাহলে আপনি বিজয় দাবি করতে পারেন।

(রিচার্ড স্টেনজেল রচিত নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮-২০১৩: পোর্ট্রেট অব অ্যান এক্সট্রাঅর্ডনারি ম্যান বই থেকে সংগৃহীত ও অনূদিত)