মানব কৃতিত্বের সূর্য যেন কখনো অস্ত না যায়

১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: এএফপি
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: এএফপি

আজ আমরা যাঁরা এখানে উপস্থিত আছি আর যাঁরা দেশের বা বিশ্বের অন্য স্থানে থেকে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন, আমরা সবাই নবমুক্তির জয়গান গাইছি। যেভাবে দীর্ঘ এক দুর্যোগের শেষে এই সমাজের জন্ম হলো, তা নিঃসন্দেহে মানবসভ্যতার এক গর্বের নিদর্শন হয়ে থাকবে।

আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকার জনসাধারণকে এমন এক দেশ গড়তে হবে, যেন বিচারব্যবস্থায় মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায়, মানব আত্মার মহত্ত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস হয় সুদৃঢ় আর সবার জন্য সুন্দর এক জীবনের আশা হয় চিরন্তন। আমাদের কাছে এই প্রত্যাশা আমাদের নিজেদের আর সারা বিশ্বের মানুষের, যাদের প্রতিনিধিদের অনেকেই আজ এখানে আছেন।

প্রিয় দেশবাসীকে আমি বলতে চাই, আমরা প্রত্যেকে এই দেশের মাটির সঙ্গে এমনভাবে জড়িত, যেমনভাবে প্রিটোরিয়ার বিখ্যাত জাকারান্দা বৃক্ষের সঙ্গে জড়িত বুশভেল্দের মিমোসা বৃক্ষ। যতবার আমরা এই মাটি ছুঁয়ে দিই, ততবার আমরা নিজেকে আবিষ্কার করি নতুনভাবে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে পুরো দেশে। গাছগুলোতে যখন সবুজের ছোঁয়া মেলে আর ফুল ফোটে, আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হই।

এই মানসিক ও শারীরিক একাত্মবোধ বলে দেয় আমরা প্রত্যেকে কীভাবে আলোড়িত হই, যখন আমরা দেখি কোনো অন্তর্কোন্দল আমাদের ভেঙেচুরে দিচ্ছে আর সারা বিশ্ব কীভাবে আমাদের অচ্ছুত করে দিয়েছে আমাদের চূড়ান্ত বর্ণবৈষম্য প্রথার কারণে।

আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ আজ আনন্দিত যে বিশ্বমানবতা আজ আমাদের আবার বুকে টেনে নিয়েছে, যেখানে কিছুদিন আগেও আমরা ছিলাম অনাহূত। আজ আমরা সারা বিশ্বকে আতিথেয়তা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি আর তাই আমরা আমাদের অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে তারা আমাদের সঙ্গে সুশাসন আর শান্তি প্রতিষ্ঠার এই বিজয় উৎসবে শামিল হয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, শান্তি, অহিংসা, বর্ণবিদ্বেষহীনতা আর লিঙ্গবৈষম্যহীন এক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন।

এই সাফল্যের জন্য দেশের জনগণকে, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, ধর্মীয়, যুব, ব্যবসায়ী, সনাতনপন্থী নেতাদের আমরা বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। বিশেষ করে আমার দ্বিতীয় উপরাষ্ট্রপ্রতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ককে।

>ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক ভাষণে শান্তি, অহিংসা, বর্ণবিদ্বেষহীনতা আর লিঙ্গবৈষম্যহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর পাশে থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানান

আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সব স্তরের সব কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রতিও জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা, একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য। যার ফলে আজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে রক্তলিপ্সু কিছু শক্তির হাত থেকে, যারা এখনো আলো দেখতে চায় না।

সময় এসেছে ব্যথা ভুলে যাওয়ার। এখন সময় পারস্পরিক মেলবন্ধনের। অবশেষে আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি ঘটেছে। আজ এই দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, সব দারিদ্র্য, দুর্দশা, বঞ্চনা আর বৈষম্য থেকে সবাইকে মুক্ত করব।

আপেক্ষিক শান্তি প্রতিষ্ঠার শেষ পদক্ষেপ গ্রহণে আমলা সফল হয়েছি। আমরা নিজেরা প্রতিজ্ঞা করি যে একটি পূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করব। আমরা লাখ লাখ মানুষের বুকের মধ্যে লালন করা প্রত্যাশা পূরণে জয়ী হয়েছি। আমাদের এমন একটি সমাজ তৈরি করা উচিত, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকান সাদা ও কালো একসঙ্গে হাঁটবে কোনো ভয় ও সংকোচ না রেখে। মানুষের মর্যাদার অবিচ্ছিন্ন অধিকার থাকবে—একটি রংধনু জাতি হিসেবে বিশ্বে শান্তির দৃষ্টান্ত হবে।

আমরা এই দিনটি উৎসর্গ করছি দেশের সব নায়কের জন্য এবং বিশ্বে যাঁরা বিভিন্নভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে। যাতে আমরা মুক্ত হতে পারি। তাঁদের স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে এবং স্বাধীনতা হচ্ছে তাঁদের পুরস্কার।

গণতান্ত্রিক বর্ণবাদবিহীন, যৌনবৈষম্যবিহীন একজন রাষ্ট্রপতি আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের অর্পিত সম্মান ও বিশেষাধিকার দ্বারা সম্মানিত এবং সুবিধাপ্রাপ্ত। আমরা বুঝি যে স্বাধীনতা পাওয়ার কোনো সহজ রাস্তা নেই। আমরা এটাও জানি যে একা কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। একত্রে এই দেশ পুনর্গঠন ও নতুন এক বিশ্বকে জানান দিতে আমাদের অবশ্যই একত্রে কাজ করতে হবে।

সবার জন্য বিচারাধিকার নিশ্চিত হোক। শান্তি প্রতিষ্ঠা পাক। কাজ, খাবার, পানি ও লবণের অধিকার সমান হোক সবার। চলো, সবাইকে এমনভাবে জানি, যাতে নিজেদের আত্মার মুক্তি মেলে। এই দেশে যেন কখনোই একে অন্যের দ্বারা নিপীড়নের শিকার না হয়। কোনো প্রকার ভোগান্তি, অশান্তি যেন বিশ্বে না হয়। স্বাধীনতার রাজত্ব চলুক। এই মানব কৃতিত্বের সূর্য যেন কখনো অস্ত না যায়।

আফ্রিকার মঙ্গল হোক।