রোহিঙ্গাদের তাড়াতে আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল মিয়ানমার

রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ছবি: রয়টার্স।
রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ছবি: রয়টার্স।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে থেকেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর আক্রমণের ‘ব্যাপক ও রীতিবদ্ধ’ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। ব্যাংককভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটসের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ফর্টিফাই গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বলে টাইম অনলাইনের এক খবরে প্রকাশ করা হয়েছে।

ফর্টিফাই তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ করা হয়েছে, তা বিশ্বাস করার যথার্থ কারণ আছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কমান্ডের চেইন অব কমান্ড এর সঙ্গে যুক্ত।

মানবাধিকারবিষয়ক ওই সংস্থা জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলকে অপরাধ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) পরিস্থিতি তুলে ধরতে বলেছে।

ফর্টিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথু স্মিথ বলেছেন, গণহত্যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে না। এ ধরনের অপরাধের জন্য দায়মুক্তি দিলে ভবিষ্যতে আরও বেশি আক্রমণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ সৃষ্টি করবে। পুরো বিশ্ব অলস বসে থেকে আরেকটি গণহত্যা ঘটার দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় থাকতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটাই এখন ঘটছে।

টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামে পরিচিত বিদ্রোহী গ্রুপ গত বছরের ২৫ আগস্ট দেশটির নিরাপত্তা সদস্যদের ওপর হামলা চালালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বেসামরিক রোহিঙ্গাদের খুন, ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংস প্রতিহিংসামূলক কার্যক্রম চালায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য করে।

ফর্টিফাই বলছে, রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা শুধু আরসার ওই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ঘটেনি। এটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আগস্ট মাসে আরসার ওই আক্রমণ চালানোর আগে ২০১৬ সালে এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময়েও মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধর্ষণ, হত্যার মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে হাজারো রোহিঙ্গাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল।

ফর্টিফাই বলেছে, ২০১৬ সালের ওই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এতে মিয়ানমার সেনাদের সাহস বেড়েছে। তারা দ্বিতীয় আক্রমণের অপেক্ষায় ছিল, যাতে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি তাড়ানো যায়।

ফর্টিফাইয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গাদের আগে থেকে তাড়ানোর পরিকল্পনার পদ্ধতিগত প্রস্তুতির বিশদ বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ছাড়া বেসামরিক রোহিঙ্গাদের আগে থেকে দুর্বল করে ফেলার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে তারা। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে প্রতিরোধে ব্যবহার হতে পারে এমন ধারালো বস্তু সরিয়ে ফেলা, স্থানীয় রোহিঙ্গাবিরোধীদের প্রশিক্ষণ, বেড়া বা স্থাপনা ধ্বংস, রোহিঙ্গাদের খাবার ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বা অস্ত্র সরিয়ে ফেলা, অপ্রয়োজনে রাখাইন রাজ্যে প্রচুর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য জড়ো করার মতো বিষয় রয়েছে।

ফর্টিফাই বলছে, জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যানালাইসিস অব অ্যাট্রোসিটি ক্রাইমসে উল্লেখ করা মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য ‘প্রস্তুতির’ সঙ্গে মিয়ানমারের কার্যক্রমের সাদৃশ্য দেখা গেছে।

ফর্টিফাইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে আক্রমণ শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্টে এবং এতে ২৭ মিয়ানমার আর্মি ব্যাটালিয়ন অংশ নেয়। মোট ১১ হাজার সেনা ও কমপক্ষে তিনটি কমব্যাট পুলিশ ব্যাটালিয়ন যুক্ত ছিল।

রাখাইনে গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ২২ সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাকে শনাক্ত করেছে ফর্টিফাই এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত করে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলা হয়েছে। ওই ২২ জনের তালিকায় মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং, ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ সো উইন, সেনা কর্মকর্তা মিয়া তুনও রয়েছেন।

গত মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধের মূল ভূমিকায় থাকা মিয়ানমারের ১৩ সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে। ইউরোপ ও কানাডা মিয়ানমারের সাত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।