তেলের দাম নিয়ে ফাটকাবাজি, ধরা হাইতির সরকার

হাইতিতে তেলের দাম বাড়া নিয়ে বিক্ষোভে লুটপাট ও আগুন দিয়ে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। ছবি: রয়টার্স
হাইতিতে তেলের দাম বাড়া নিয়ে বিক্ষোভে লুটপাট ও আগুন দিয়ে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। ছবি: রয়টার্স

ফুটবল বিশ্বকাপে বুঁদ হয়ে ছিল বিশ্ব। বাজিটা বেশি ছিল ফুটবল ঘিরেই। এর চেয়েও বড় জুয়া দেখা গেল হাইতিতে। দেশটির ফুটবলপাগল দর্শকেরা ব্রাজিলের সমর্থনে একদিকে গলা ফাটাল, অন্যদিকে দেশটির সরকার চুপিসারে চালাল ফাটকাবাজি। ফুটবল উন্মাদনার সুযোগে ৬ জুলাই দেশটিতে তেলের দাম ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিল হাইতি সরকার। একদিকে ব্রাজিলের হার, অন্যদিকে তেলের দাম বাড়ার খবরে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশটিতে।

হাইতিয়ানরা ব্রাজিলকে সমর্থন করার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণ আছে। তারা ব্রাজিলের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পায়। এমনকি ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় পেলের সঙ্গে আফ্রিকান দেশটির শিকড় আছে বলে মনে করে তারা। সেই ব্রাজিলের খেলায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষের উন্মাদনার সুযোগ নিতে চেয়েছিল দেশটির সরকার। কিন্তু সরকারের ফাটকাবাজি ধরা খেল বেলজিয়ামের কাছে ব্রাজিল হারের পর। ব্রাজিল জিতলে এতটা বিক্ষোভ হতো কি না, সে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে ব্রাজিলের হারের পর হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্স কার্যত অচল হয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা গাড়ি পুড়িয়ে, দোকান লুটপাট করে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়।

জনগণের ক্ষোভ বুঝতে পেরে হাইতির প্রধানমন্ত্রী জ্যাক গি লেফনটন্ট দ্রুত জ্বালানির তেল থেকে ভর্তুকি সরিয়ে নেওয়ার নীতি বদলে ফেললেন। কিন্তু তিনি চাকরি টেকাতে পারলেন না। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের সহিংস প্রতিবাদের মুখে এবং ১৪ জুলাই অনাস্থা প্রস্তাব আনার আগেই পদত্যাগ করতে হয় তাঁকে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ ঘটনায় দেশটির জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিনজনের।

লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশটিতে অস্থিরতা তীব্র। ২০১০ সালের ভূমিকম্পের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। ওই ভূমিকম্পে দুই লাখ মানুষ মারা যায়। এমনকি দেশটিতে বিদেশি সাহায্যও কমে গেছে। ভেনেজুয়েলার হাইতিকে যে সহযোগিতা করত, অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে তারা তা কমিয়ে দিয়েছে। সবদিক থেকে দুর্দশায় পড়েছে দেশটি। এরপরই মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে তেলের মূল্যবৃদ্ধি।

গত বছরের হাইতির প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘূর্ণিঝড় ম্যাথুর পর ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মইসি। তিনি হাইতির পরিস্থিতি ভালো করেই জানেন। নিজে বেড়ে উঠেছেন দেশটির দরিদ্র অঞ্চলে। নিজে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কলা চাষ করেছেন। এরপর জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেছেন। ক্ষমতায় আসার আছে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঘরে ঘরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, রাস্তা নির্মাণ, খাল খননসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তার সঙ্গে বাস্তবের অনেক ফারাক। রাষ্ট্রীয় অবস্থার দুর্বলতাগুলো তার সাফল্যের পথে বাধা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, হাইতিয়ানদের সম্পদ বা সামর্থ্য নিয়ে। মইসির প্রথম পদক্ষেপ ছিল ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) সঙ্গে একটি চুক্তি করা। চুক্তিতে আইএমএফ জ্বালানিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। তাদের মতে, এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে ও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। হাইতির সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তার ৮৫ শতাংশই চলে যায় দেশটির ১০ শতাংশ ধনী নাগরিকদের হাতে।

প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ উইলসন ল্যালেউ বলেন, হাইতি থেকে ছয় হাজার ব্যারেল জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকে চলে যায়। ভর্তুকি বাদ দিলে ৩৫ কোটি ডলার বাঁচানো সম্ভব, যা অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। হাইতি তার মোট জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় করতে পারে। লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশের তালিকায় থাকা হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া এর চেয়ে বেশি এসব খাতে ব্যয় করতে পারে।

ইকোনমিস্ট বলছে, বড়লোকদের সুবিধা বাদ দিয়ে গরিবদের সাহায্য করা হবে—এ কথা সহজে জনগণকে খাওয়ানো যায়। তবে নিজের ফাটকাবাজিতে নিজেই ধরা খেয়েছে হাইতির সরকার। তারা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর পরিবর্তে সুবিধাগুলো তুলে ধরেনি। গরিব ও কর্মজীবীরা এ থেকে কী লাভ পাবেন, সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে সুবিধা থাকবে কি না, তারা জনগণকে বোঝাতে পারেনি।

সেনাবাহিনীহীন দেশটিতে বিশৃঙ্খলা বা বিক্ষোভ ঠেকানো সরকারের জন্য কঠিন বিষয়। যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকলেও বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারত কি না সন্দেহ। ২০১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীরা দেশটিতে কাজ করছিলেন। গত অক্টোবর মাসে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক সেনারা সেখানে জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৯৫ সালে দেশটির সেরাবাহিনী বিলুপ্ত করা হয়। দেশে শক্তিশালী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতে কম বেতনের পুলিশ সদস্য দিয়ে ভবিষ্যতে দাঙ্গা কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে, সে প্রশ্ন উঠতে পারে।

অবশ্য কিছু সরকারি কর্মকর্তা সন্দেহ করছেন, দেশটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ভর্তুকি থেকে সুবিধা পাওয়া জ্বালানি চোরাচালানকারী, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা শক্তিশালী পরিবারের হাত থাকতে পারে। ব্রাজিল-বেলজিয়াম খেলা শেষ হতে না হতেই অনেক রাস্তাঘাট বন্ধ করে টায়ার পুড়িয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থাকলে প্রেসিডেন্ট মইসিকে তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংগ্রাম করতে হবে।

ইকোনমিস্ট বলছে, হাইতিতে মইসির রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক অবকাঠামোকে সুগঠিত করতে পারেননি। এখন ভর্তুকিসুবিধা পুনর্বহাল করতে হলে মইসিকে নতুন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু জনসমর্থন নিজ পক্ষে আনতে সরকারের অর্থ খরচের সামর্থ্য সীমিত। দেশটিতে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৭০ হাজার করদাতা। দুর্নীতির কারণে বিদেশি সাহায্যদাতারা নিজেদের এনজিওর বাইরে সাহায্য দিতে চায় না। এতে সক্ষমতা বাড়াতে পারছে না দেশটি।

এখন সমস্যা মোকাবিলা মইসিকে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করতে হবে। ক্ষমতায় আসার আগে ক্যারাভান ফর চেঞ্জ ব্যানারে তিনি বিভিন্ন শোভাযাত্রা করেছিলেন। সেখানে সরকারের নানা ভালো কাজ তুলে ধরেন তিনি। তবে দুর্ভাগ্যবশত তেল নিয়ে যে ফাটকাবাজি হলো, এটি তার প্রচেষ্টার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।