কাতারের ওপর ইউএইর অবরোধ 'জাতিগত বৈষম্য'

দোহায় উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সারি সারি সুউচ্চ ভবন। রয়টার্স ফাইল ছবি
দোহায় উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সারি সারি সুউচ্চ ভবন। রয়টার্স ফাইল ছবি

কাতারের ওপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবরোধ আরোপকে ‘জাতিগত বৈষম্য’ বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। কাতারের আমিরের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে এ তথ্য জানানো হয়।


সন্ত্রাসবাদে আর্থিক সহায়তা ও মদদ দিয়ে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরির অভিযোগ তুলে গত বছরের জুনে আকস্মিকভাবে কাতারের ওপর কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও যোগাযোগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একতরফা অবরোধ আরোপ করা হয়। সৌদি আরবের নেতৃত্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর এই অবরোধের ঘোষণা দেয়। পরে আরও তিনটি দেশ এই অবরোধে শামিল হয়। শুরুর দিকে বেশ বেকায়দায় পড়েছিল কাতার। দেশটির সঙ্গে আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে থাকা যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয় অবরোধকারী দেশগুলো। এমনকি অন্যান্য আরব দেশে থাকা কাতারের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়।

তবে দোহা কর্তৃপক্ষ বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের ঘটনাকে কয়েক দশকের মধ্যে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) ইতিহাসের সবচেয়ে কূটনৈতিক বিরোধ বলে মনে করা হয়।

এই অবরোধের এক বছর পর গত মাসে কাতার আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) অভিযোগ দায়ের করে। সেখানে বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিভিন্ন প্রয়োজনে থাকা কাতারের হাজার হাজার মানুষকে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে এবং কাতারের সঙ্গে আকাশসীমা ও সমুদ্রবন্দর বন্ধ করে ইউএই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। এসব লোকজনের অনেকের ইউএইতে পরিবার বা সম্পত্তি আছে।

অভিযোগে বলা হয়, এই বয়কট জাতিগত বৈষম্যসহ ইলিমিনেশন অব অল ফরমস অব রেইশল ডিসক্রিমিনেশন (সিইআরডি) বিষয়ক আন্তর্জাতিক সমঝোতা লঙ্ঘন করেছে। কাতার ও ইউএই—দুই দেশ এ চুক্তি সই করে। তবে সৌদি আরব, বাহরাইন ও মিসর এই চুক্তিতে নেই।

গতকাল সোমবার আইসিজে আদেশে বলেছেন, ইউএইর পদক্ষেপের কারণে কাতারের যেসব পরিবারকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে, তাদের অবশ্যই একত্র হতে দিতে হবে। একই সঙ্গে ইউএইতে কাতারের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করতে দিতে হবে। অথবা তারা এখানে যতটুকু পড়াশোনা করেছে, তার সনদ দিতে হবে, যাতে তারা অন্যত্র পড়তে পারে এবং ইউএইর বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে পারবে সেখানে থাকা কাতারের নাগরিকেরা।

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী টম কাডম্যান আইসিজের এ রায়কে ‘কাতারের বিরাট সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

১৯৮১ সালে জিসিসি গঠন করে আরব দেশগুলো। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা মুক্তভাবে চলাচল করতে পারতেন। কারণ, আরব অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠী উপসাগরীয় অঞ্চলের নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাই যোগাযোগের সুবিধার্থেই এ নিয়ম চালু ছিল। কিন্তু কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের পর থেকে এই নিয়মে ব্যত্যয় ঘটতে থাকে।

কাতারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর মূল অভিযোগ হলো, কাতার ইসলামি কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে, সমর্থন করে মুসলিম ব্রাদারহুডকে। তা ছাড়া ইরানের সঙ্গে কাতারের দহরম-মহরমও পছন্দ করে না সৌদি আরব। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানবিরোধী মানসিকতা থেকেই কাতারকে একঘরে করতে চায় সৌদি আরব।

ইকোনমিস্ট বলছে, সৌদি আরবসহ চারটি দেশের মূল আপত্তির বিষয় হলো কাতারের আমিরের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। এত দিন আরব অঞ্চলের সব সংবাদমাধ্যম শাসকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আসছিল। বিরুদ্ধবাদী হয়েছে একমাত্র আল-জাজিরা। আর তাতেই শঙ্কিত আরব দেশগুলোর একনায়কেরা। এই সংবাদমাধ্যমকে অনেকেই কয়েক বছর আগের আরব বসন্তের উসকানিদাতা বলে মনে করে থাকেন। উপসাগরীয় অঞ্চলের একনায়ক শাসকেরা আল-জাজিরাকে তাঁদের ক্ষমতার জন্য হুমকি বলে মনে করেন। বিশেষ করে এই সংবাদমাধ্যমের টেলিভিশন চ্যানেলে যেভাবে অন্যান্য আরব দেশের শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, তাতেই ভয় দেশগুলোর। শাসকদের আশঙ্কা, এই সংবাদমাধ্যমের কারণে তাঁদের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আল-জাজিরার আরবিভাষী চ্যানেলটি কাতার সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। আরব অঞ্চলে মুক্ত মত প্রচারের নামে এটি সন্ত্রাসবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং এর প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতাও কম। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে সংবাদমাধ্যমটির অবস্থান পুরোপুরি পশ্চিমাবিরোধী ছিল। অন্যদিকে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানকার মানবিক পরিস্থিতির বিপর্যয় নিয়ে টুঁ শব্দটি করেনি আল-জাজিরা।

আরব বসন্ত বা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে আল-জাজিরা। ইকোনমিস্টকে দেওয়া তাদের বক্তব্য, এ ধরনের অভিযোগ আরব অঞ্চলের জনসাধারণকে অবমাননার শামিল। নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়েই মানুষ আরব বসন্ত বিপ্লবে যোগ দিয়েছিল।