ইমরানের 'মধুচন্দ্রিমা' কত দিন?

ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স
ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৪ আগস্ট শপথ নিচ্ছেন ইমরান খান। ইতিমধ্যে তিনি সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৭ আসন নিশ্চিত করতে মিত্রদের সমর্থন পেয়েছেন। প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ইমরান। সেই রোমাঞ্চ অবশ্যই কাজ করবে ইমরানসহ তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু ক্ষমতায় বসে কত দিন ‘হানিমুন মুডে’ থাকতে পারবেন তিনি? সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।

ইমরানের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো পাকিস্তানের অর্থনীতি। এ মুহূর্তে দেশটির অর্থনীতি বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। রিজার্ভ ৯০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে বড়জোর দুই মাসের আমদানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে দেশটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ সহায়তা পেতে দেনদরবার চলছে। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর অবশ্য অবকাঠামো খাতে ইতিমধ্যে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার সহায়তায় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সমস্যা হলো এসব প্রতিশ্রুতি কিংবা আইএমএফের সহায়তা পেতে যেসব শর্ত মানতে হয়, তা একটি জনপ্রিয় সরকারকে মাটিতে টেনে নামানোর জন্য যথেষ্ট। ‘ইসলামভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ইমরানের জন্য এসব সহায়তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ক্ষমতা নিয়েই ইমরানকে লোডশেডিং মোকাবিলার কঠিন দায়িত্ব সামাল দিতে হবে। বিগত সরকার কোনোভাবেই লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় আনতে পারেনি। তবে চীনের সহায়তা নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে তারা। এটা করতে গিয়ে ঋণচক্রে পড়েছে এ খাত। ভর্তুকি কমিয়ে দিয়ে ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এ খাতের একটা সমাধান খুঁজতে হবে ইমরানকে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া তার জন্য বেশ কঠিনই হবে।

ইমরানকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে জটিল হিসাব-নিকাশে বসতে হবে। দেশটিতে কট্টরপন্থীরা আবারও গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় দেশটির বেশ কিছু চিহ্নিত কট্টরপন্থী দলকে অংশ নিতে দেখা গেছে। আবার কিছু কট্টরপন্থী সংগঠন এই প্রক্রিয়ারই বিরুদ্ধে। বেশ কটি নির্বাচনী সমাবেশে হামলা চালায় তারা। এই হামলা থেকে রেহাই পায়নি ইমরানের কট্টরপন্থী আদর্শের দলও। ইমরান সেই হামলাকারীদের কীভাবে মোকাবিলা করেন, সেটা দেখার বিষয়।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে হিসাব মেলানো ইমরানের জন্য হবে আরও কঠিন। আঞ্চলিক কূটনীতিতে আমেরিকা-চীন ও চীন-ভারত প্রভাবের মধ্যে পাকিস্তানকে কীভাবে তুলে ধরবেন, সেটা ভাবতে হবে। ইমরান আমেরিকার কট্টর সমালোচক। পাকিস্তানে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে মার্কিন ড্রোন হামলার প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ইসলামাবাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কও খানিকটা তিক্ত, আর ভারত তো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইমরান অবশ্য বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণে বলেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারত এক পা এগোলে তিনি দুই পা এগোবেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। এটা পরিষ্কার যে নওয়াজ শরিফ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পথে এগিয়েছিলেন, সেটাকে ভালোভাবে নেয়নি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। নওয়াজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নানা কারণের মধ্যে এটাকে একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়। কারণ, সেনাবাহিনী কখনোই ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মেনে নেবে না। ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের সেহার তারিক দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েই পাকিস্তানের যেকোনো বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে টানাপোড়েনের সম্পর্কের সূচনা হতে পারে।

ইমরান সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বলে প্রচার রয়েছে। নির্বাচনের পর প্রধান ছয়টি রাজনৈতিক দল কারচুপির অভিযোগ তুললেও ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) তা নাকচ করে দিয়েছে। ইমরানের প্রতি সেনাবাহিনীর মদদের কথা নির্বাচনের আগে এতটাই চাউর হয়েছিল যে সেনাবাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে তা অস্বীকার করেছিল। তবে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে কখনোই এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু কত দিন ইমরান সেনাবাহিনীর সুদৃষ্টিতে থাকবেন?

বাস্তবতা হলো, আজ হোক বা কাল, ইমরানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব শুরু হবেই। বিশ্লেষক ফারুক তিরমিজি বলেন, ইমরান আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পক্ষে। আর সেনাবাহিনী চায় প্রায় ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া গড়ে তুলতে। ইমরান স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বেশি বরাদ্দ রাখতে চান। সেটা করতে হলে সেনাবাহিনীর বাজেটে টান পড়বে। এ বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হবেই। ইমরান ও সেনাবাহিনীর এই লড়াই হবে ‘বন্দুক বনাম টেক্সট বুকের’ লড়াই।

পাকিস্তানের ইতিহাসও বলে, ইমরানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব শুরু হবেই। ইমরানের মতো আরও রাজনৈতিক নেতাকে কাছে টেনেছিল সেনাবাহিনী, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাঁকে ছুড়েও ফেলেছে। এ পর্যন্ত দেশটিতে যাঁরা ক্ষমতাসীন হয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়েই ক্ষমতা পেয়েছিলেন তাঁরা। প্রায় ৭১ বছর বয়সী এই দেশে এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ইমরান কি তার ব্যতিক্রম হতে পারবেন? সময়ই তা বলে দেবে। তবে আপাতত ক্ষমতায় বসার পর সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জটিল হিসাবগুলো তাঁকে মেলাতে হবে। তাই ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বোধ হয় খুব লম্বা হবে না ইমরানের!