ইমরান খান ব্যাটিংয়ে কতক্ষণ টিকবেন?

ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স
ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার প্রহর গুনছেন ইমরান খান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিয়ে রাজনীতিতে নেমে গঠন করেন তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। দল গঠনের ২২ বছরের মাথায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। এককভাবে না হলেও কোয়ালিশনের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসছে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান প্রতিষ্ঠিত পিটিআই। বর্ণাঢ্য জীবনে নানা কারণে বিতর্কিত হলেও পাকিস্তানে এখন বেশ জনপ্রিয় ইমরান খান। এবার দেশ পরিচালনার ভার পড়ছে তাঁর কাঁধে। দেশটির ৬৪ শতাংশ তরুণ এখনো তাঁর সমর্থক। এঁরাই তাঁর শক্তিও। তবে তাঁর ব্যাটিং শুরু হলেও কতক্ষণ টিকে থাকবেন, তা সময়েই বলবে। কারণ, বোলিং সেনাবাহিনীও শুরু করতে পারে।

মধ্যবিত্তের বিপ্লব
ইমরান খানের জয়ে অনেকেই বিস্মিত। অনেকেই ভোট কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। তবে তাঁর পক্ষেও সোচ্চার অনেকেই। দেশটির নির্বাচন বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পশ্চিমা নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা পাকিস্তানের ওপরতলার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিপরীতে ক্রমবর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুভবের গভীরতাকে অবমূল্যায়ন করেছেন। মধ্যবিত্তরা একটি নতুন নেতৃত্ব চেয়েছেন। আয়েশা এএফপিকে বলেছেন, খানের বিজয় ‘মধ্যবিত্তের বিপ্লব’।

পাকিস্তান পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহৎ সামরিক বাহিনী। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এরা। কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রভাববলয়ে রাজনৈতিক দিক দিয়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্র আজও স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।

পরিবারতন্ত্রের অবসান
ইমরান খানের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে কয়েক দশকের পরিবারতান্ত্রিক শাসনের অবসান হতে যাচ্ছে পাকিস্তানে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি এক শুভ বার্তা। ইমরান খানকে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে—‘চরমপন্থীদের’ নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক সংকট, যে কারণে আইএমএফের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে, পানি ও বিদ্যুৎ-সংকট এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা স্ফীতি। এ ছাড়া পাকিস্তানি সমাজে ধনবৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইমরান। তবে কেউ কেউ অভিযোগ করেন, ‘চরমপন্থীদের’ বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন এবং যাবেন। তাঁকে মনে রাখতে হবে, পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণভাবে মুসলমানরা এখন কোণঠাসা অবস্থায় আছে। এই অবস্থার প্রতিবাদ করেন যেসব ধর্মপ্রাণ তরুণ, ঢালাওভাবে তাঁরা ‘চরমপন্থী’ বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকেন। মজার ব্যাপার, মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত করে রেখে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো ইহুদিদের পশ্চিমারা কখনোই ‘চরমপন্থী’ বলে না।

নতুন যুগের সূচনা
ইমরান খান ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে ক্রিকেটে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিয়েছেন। এবার তাঁর সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তা হলো পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নতুন যুগের শুরু করা। পাকিস্তানি তরুণদের মনোজগতে ১৯৯২-এর সেই উদ্দীপনা তিনি চালকের আসনে বসে আবার জাগাতে পারবেন, সেই আশায় বুক বেঁধে আছেন তাঁরা। ইমরানের জয়ে বিস্মিত হয়ে নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনেছেন, তাঁদের উদ্দেশে পাকিস্তানের নির্বাচন বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেছেন, পশ্চিমা নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা পাকিস্তানের ওপরতলার দুর্নীতিগ্রস্তদের বিপরীতে ক্রমবর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুভবকে অবমূল্যায়ন করেছেন। মধ্যবিত্তরা একটি নতুন নেতৃত্ব চেয়েছে।

চালক ইমরান, পথ এবড়োখেবড়ো
লাহোরভিত্তিক সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী গুল বুখারি বলেছেন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় পিটিআই নেতৃত্বাধীন ভবিষ্যৎ জোট সরকারের বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ। ইমরানকে জেতানোর জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করেছে সেনাবাহিনী। নানান বাধা ডিঙিয়ে ইমরান ‘ফিনিশ লাইন’ ছুঁয়েছেন। চালকের আসনে বসে পাকিস্তানকে এগিয়ে নিতে যাচ্ছেন ইমরান। তবে পথ কিন্তু এবড়োখেবড়ো এবং অনিশ্চিত।

পাকিস্তানের জন্ম থেকেই সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। ইমরান খানের টিকে থাকা-না থাকা নির্ভর করছে সেনাবাহিনীর ওপর। তাঁকে ক্ষমতায় আনতে যেমন সেনারা সবচেয়ে ভূমিকা রেখেছে, তাঁর ক্ষমতায় থাকার পথের প্রধান বাধাও তারা। অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইমরান আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর কবজা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন প্রধানমন্ত্রী হতে চেষ্টা করবেন। তিন চেষ্টা করলেই যে পারবেন, তা মনে হয় না। কারণ, সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে বের হতে চাইলে তাঁকে বৈরী পরিবেশের মুখে পড়তে হবে। সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পা বাড়ালে ইমরানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সেনাবাহিনীর জন্য কঠিন কিছুই না। অতীত তা-ই বলে।

বাস্তবতা হলো, আজ হোক বা কাল, ইমরানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব হবেই। বিশ্লেষক ফারুক তিরমিজি বলেন, ইমরান আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পক্ষে। আর সেনাবাহিনী চায় প্রায় ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া গড়ে তুলতে। ইমরান স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বেশি বরাদ্দ রাখতে চান। তাই ইমরান ও সেনাবাহিনীর এই লড়াই হবে ‘বন্দুক বনাম টেক্সট বুকের’ লড়াই।

পাকিস্তানের মতো একটি বিশৃঙ্খল দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা ডেনিয়েল মার্কি একটি বার্তা সংস্থাকে বলেন, ‘ইমরান একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় আগের সরকারের সেই পুরোনো লোকবলের সঙ্গেই কাজ করতে হবে। এ ছাড়া তাঁর পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী—এমন অভিযোগও রয়েছে। ফলে নতুন কিছু দেখাতে পারবেন বলে মনে হয় না।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিযোগ, পাকিস্তানে একটি ‘কসমেটিক’ পরিবর্তন হয়েছে। কে না জানে, সেনাবাহিনীর স্বার্থ উদ্ধার হলে তারা ইমরান খানকে ছুড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না, যা ঘটেছে নওয়াজ শরিফের বেলায়।