যে গ্রামে বইয়ে মগ্ন পাঠকেরা

ভিলার গ্রামই হলো ভারতের প্রথম ‘বুক ভিলেজ’ বা ‘বইয়ের গ্রাম’। ছবি: এএফপি
ভিলার গ্রামই হলো ভারতের প্রথম ‘বুক ভিলেজ’ বা ‘বইয়ের গ্রাম’। ছবি: এএফপি

মহারাষ্ট্রের ভিলার গ্রামে গিয়ে অবাক হন পর্যটকেরা। যেসব ডানপিটে শিশুকে পিটুনি দিয়েও পড়ার টেবিলে বসানো যায় না, তারাই কিনা বসে আছে গ্রন্থাগারে। নিবিষ্ট হয়ে পড়ছে বই। বড়রাও যেন কাজের ফাঁকে একটু ফুরসত পেলেই ছুটে যাচ্ছেন গ্রন্থাগারে। এই পরিবেশই যেন গ্রামকে করেছে অনেক শান্ত ও অভিজাত।

মহারাষ্ট্রের এই ভিলার গ্রামই হলো ভারতের প্রথম ‘বুক ভিলেজ’ বা ‘বইয়ের গ্রাম’। এর অনুপ্রেরণা এসেছে ব্রিটেনের হেই-ও-ওয়াই বইয়ের দোকান থেকে। সাহিত্যবিষয়ক উৎসবের জন্য বিখ্যাত ওয়েলসে শহরের অনুকরণে হয়েছে তৈরি।

বুক ভিলেজ কেবল একটি গ্রন্থাগার নয়, গ্রামজুড়ে তৈরি গ্রন্থাগার। এ এক অদ্ভুত জগৎ। মনের ক্ষুধা, জ্ঞানের পিপাসা মেটানোর এক অসাধারণ স্থান এটি। চঞ্চলতা না থাকলেও মোটেও বিষাদে ঘেরা নয় গ্রামটি। পাহাড়ি এই গ্রামের সব মানুষ বই ভালোবাসেন, বই পড়েন। তাই গ্রামের বইপ্রেমী, একই সঙ্গে ভ্রমণে উৎসুক মানুষের জন্য ‘বুক ভিলেজ’ ছিল নতুন একটি উদ্যোগ।

গত বছরের ৪ মে যাত্রা শুরু করে এটি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বর ও পঞ্চগনি শহরের মাঝে অবস্থিত ভিলার অতি জনপ্রিয় একটি হিল স্টেশন। রাজ্য সরকারের লক্ষ্য ছিল গ্রামটিতে পড়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণীয় করে তোলা। সরকারি সংস্থা মারাঠি ভাষা ডিপার্টমেন্ট এবং রাজ্য মারাঠি বিকাশ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে প্রথম এই কার্যক্রম শুরু হয়।

ওই বছর এক সাক্ষাৎকারে শিক্ষামন্ত্রী বিনোদ তাওদে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলাম। সুযোগ হয়েছিল হেই-ও-ওয়াই ও ওয়েলসে শহর ঘুরে দেখার। ওই দিন থেকেই মহারাষ্ট্রে ওই ধরনের একটি বইয়ের শহর গড়ে তোলার ইচ্ছে হয় আমার। প্রকল্পের জন্য অনেক গ্রাম খুঁজে বেছে নিতে হয়েছে। এমনকি ভিলারকে তালিকাভুক্ত করার পর ভূমিবিষয়ক পরীক্ষা করে নিই আমরা। আমি খুবই আনন্দিত যে স্বপ্নটা বাস্তবে পরিণত হয়েছে।’

বুক ভিলেজ কার্যক্রমের শুরুতে প্রায় ১৫ হাজার মারাঠি ভাষার বই দেয় মহারাষ্ট্র সরকার। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি, স্কুল, ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে মোট ২৫ ধরনের গ্রন্থাগার তৈরি করা হয়। শুরু থেকেই সরকারের অনুদানের বই ছাড়াও সেখানে আরও অনেক বই ছিল। সাহিত্য, জীবনচরিত, আত্মজীবনী, কাব্যগ্রন্থ, ধর্মশাস্ত্র, ইতিহাস, পরিবেশ, লোকসাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ের বই পড়তে পারেন গ্রামের মানুষ ও পর্যটকেরা। বুক ভিলেজে প্রথম পর্যায়ে মারাঠি ভাষার বই পড়ার সুযোগ পান পাঠকেরা। এখন ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার বই পড়ার সুযোগও মিলেছে। তবে ভাষার বিষয়টি নিয়ে কোনো সীমা বেঁধে দিতে চায়নি সরকার। কারণ, এর মূল্য লক্ষ্য পাঠকের তৃষ্ণা মেটানো।

একটি জাতির মেধা, মনন, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারণ ও লালনপালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে। তাই গ্রন্থাগারকে বলা হয় ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’। এই ধারণাই যেন বুক ভিলেজকে সমৃদ্ধ করেছে।

ভিলার গ্রামে বাস করে প্রায় তিন হাজার মানুষ। তাদেরই একজন বালাসাহেব ভিলারে। নিজের বাড়ির একটি অংশ গ্রন্থাগারে দিয়েছেন তিনি। তাঁর বাড়ির গ্রন্থাগারে রয়েছে সাহিত্য, কবিতা, ধর্ম, ইতিহাস, পরিবেশ, উপকথা, জীবনচরিত, আত্মজীবনীমূলক বই। বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অনেক পর্যটক গুজরাটি, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার বই রাখার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাই গ্রন্থাগারের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৫ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষই গ্রন্থাগারের জন্য জায়গা দিতে প্রস্তুত। প্রতিটি ভাষার দুই হাজার থেকে তিন হাজার বই থাকবে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে পর্যটক সমাগম অনেক বাড়বে বলে মনে করেন ভিলারে।

বুক ভিলেজ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ভিনেই মাভালঙ্কার বলেন, শিক্ষামন্ত্রী বিনোদ তাওদে এই গ্রন্থাগারে গুজরাটি, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার বই রাখার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

মারাঠি বিশ্বকোষ সেন্টারের সহকারী সেক্রেটারি ড. জগদানন্দ ভাটকার বলেন, এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল মারাঠি ভাষা, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ সাহিত্যকে প্রচার করা। বর্তমানে এই বুক ভিলেজে মারাঠি ভাষার ২৫ হাজার বই আছে।

বইয়ের টানে গত ১৫ মাসে ভিলার গ্রামে পর্যটক সমাগম বেড়েছে অনেক। পাহাড়ি এই এলাকায় ঘুরতে এসে পর্যটকদের মনোযোগ কেড়ে নেয় বই। রাজ্য মারাঠি বিকাশ সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, আগে ছুটির সময় মানুষ এখানে-ওখানে বেড়াতে যেতেন। এখন সবাই গ্রামেই থাকেন। আগত অতিথিদের সমাদর করেন।

প্রতিবছরই প্রায় ৪০ লাখ পর্যটক আসেন এখানে। গত ১০ বছরে কৃষি পর্যটনের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে ভিলার। এই গ্রামে ব্যাপক হারে স্ট্রবেরির চাষ হয়। এ দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আসে। এর মধ্যে গত এক বছরে বুক ভিলেজ নামে পরিচিত পাওয়ার পর নতুন করে অনেক মানুষ এসেছেন গ্রামে। তাঁর মূলত গ্রন্থাগারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে গ্রামটিতে থাকতে আসছেন।

মানুষের জীববোধের এক নতুন দর্শন দেয় এই বুক ভিলেজ। বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকে পৃথিবী চেনার এক নতুন উপায় বের করে দিয়েছে এই গ্রন্থাগার। ছোট ছেলেমেয়েরাও আগ্রহী হয়ে উঠছে বই পড়ায়।

অমিত ভেংসরকার মুম্বাইয়ের একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেন। বিভিন্ন টুইটে গ্রামটি সম্পর্কে জেনে এখানে আসেন তিনি। সঙ্গে আছেন স্ত্রী, সন্তান ও শ্বশুর। এখানে একটি রিসোর্টে উঠেছেন। মারাঠি সাহিত্যের দুর্লভ সংগ্রহ পেয়েছেন তিনি। অমিত একসময় অবাক হয়ে দেখেন, তাঁর ১১ বছরের মেয়েও তাঁর নানার সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে বই পড়ছে। বিষয়টি তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, বাচ্চারা এখন বইয়ের পড়ার আনন্দ থেকে অনেক দূরে থাকে। আর সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে যন্ত্র ছাড়া নিজের জীবনের কিছুই ভাবতে পারিনি আমি। এখানে এসে দুই বয়সের দুটি মানুষকে বইয়ের জড়তে আটকে ফেলেছে এই গ্রন্থাগার।’

বুক ভিলেজ উদ্বোধনের পর ভিলারে এসে থাকতে শুরু করেন সুরিয়াভানসি। তিনি বলেন, কেবল ঘুরে বেড়ানো, ভ্রমণই সব নয়। এগুলো ছাড়াও একটি নতুন দর্শন দেয় ভিলার। পরিবারগুলো তাদের অবসর বই নিয়ে কাটায়।

গ্রন্থাগারে এমনভাবে বইগুলো সাজানো, পাঠক চাইলের খুঁজে পান তাঁর মনের মতো বইটি। শুরুতে গ্রন্থাগার থেকে বই কেনার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে এখন কিছু কিছু স্টল খোলা হয়েছে, যেখান থেকে পর্যটকেরা বই কিনে নিয়ে যেতে পারেন।