ইয়েমেনে স্কুলবাসে হামলায় ব্যবহৃত বোমাটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি: সিএনএন

নিহত এক শিশুর লাশের কফিনের সামনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এক ব্যক্তি। ছবি: এএফপি
নিহত এক শিশুর লাশের কফিনের সামনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এক ব্যক্তি। ছবি: এএফপি

ইয়েমেনে শিশুদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমাই ব্যবহার করা হয়েছে। হামলার পরপরই স্থানীয় পর্যায় থেকে এ অভিযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ঘটনার এক সপ্তাহ পর মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন বিভিন্ন সূত্র ধরে নিজস্ব তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

গতকাল শুক্রবার সিএনএন অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ আগস্ট ইয়েমেনের সাদা প্রদেশে একটি স্কুলবাসের ওপর সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বিমান হামলা চালায়। এতে ৪০ জন শিশু নিহত হয়। সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তির আওতায় এই বোমাগুলো যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি করেছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ইয়েমেনের স্থানীয় সাংবাদিক ও যুদ্ধোপকরণ বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য যাচাই করে সিএনএন বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে খবরে। মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কন্ট্রাক্টর লকহিড মার্টিনের তৈরি ২২৭ কেজি ওজনের লেজার রশ্মিচালিত এমকে ৮২ বোমা ব্যবহার করা হয় হামলায়।

হামলার পরপর ইয়েমেনের একজন স্থানীয় সাংবাদিক বোমার টুকরার অংশবিশেষের ছবি প্রকাশ করে তা মার্কিন বোমা বলে দাবি করেছিলেন।

সিএনএনের খবরে বলা হয়, এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইয়েমেনের একটি দাফন অনুষ্ঠানে বিমান হামলায় ১৫৫ জন নিহত হয়। ওই হামলায় ব্যবহৃত বোমার সঙ্গে এই বোমার মিল রয়েছে। ওই সময় ‘ভুল তথ্যের’ ভিত্তিতে বোমা হামলাটি চালানো হয় উল্লেখ করে এর দায় স্বীকার করেছিল সৌদি জোট।

ওই বছরের মার্চে ইয়েমেনের একটি বাজারে সৌদি জোটের বোমা হামলায় ৯৭ জন নিহত হয়। ওই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সুনিপুণ লক্ষ্যভেদী এমকে ৮৪ বোমা ব্যবহার করা হয়। দাফন অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনার পর ‘মানবাধিকার ইস্যুতে’ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই প্রযুক্তির বোমা সৌদি আরবের কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ করেন। ট্রাম্প প্রশাসনে রেক্স টিলারসন (এ বছরের মার্চে তাঁকে বরখাস্ত করেন ট্রাম্প) পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের মার্চে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। গত বছর সৌদি আরব সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সঙ্গে প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সৌদি আরবের প্রধান প্রধান অস্ত্র বিক্রেতা।

বিমান হামলায় ব্যবহৃত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি লেজার রশ্মিচালিত এমকে ৮২ বোমার অংশবিশেষ। ছবি: টুইটার
বিমান হামলায় ব্যবহৃত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি লেজার রশ্মিচালিত এমকে ৮২ বোমার অংশবিশেষ। ছবি: টুইটার

যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সৌদি জোটের স্কুলবাসের ওপর হামলার পর পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে প্রশ্ন উঠে আসছে যে এরপর আর মানবিকতা লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান থাকে কি না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, ইয়েমেনে বিদ্রোহী গ্রুপ হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদি জোটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত নেই। অথচ শত কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করার মাধ্যমে জোটকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব অস্ত্র দিয়েই বিমান হামলা চালাচ্ছে সৌদি জোট। এ ছাড়া জোটের পক্ষে গোয়েন্দা তথ্য দিয়েও সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র।

স্কুলবাসের ওপর হামলার ঘটনার তথ্য তুলে ধরে খবরে বলা হয়, স্কুলশিক্ষার্থীরা ওই বাসে করে ঘুরতে যাচ্ছিল। ওই সময় শিশুরা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ছিল। বোমা হামলায় ৫১ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ৪০ জন শিশু। হামলায় ৭৯ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ জন শিশু।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ব্যস্ত বাজারের মাঝ বরাবর সরাসরি বোমার আঘাত হানা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি জানান, বাসটিতে বোমা আঘাত করতে দেখেছেন তিনি। এ ছাড়া বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানের ওপর বোমার আঘাত লেগেছে। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলো সেখানে থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে ছিটকে পড়ে। হতাহত ব্যক্তিরা এদিক-ওদিক পড়ে ছিল। আতঙ্কে তিনি সেখান থেকে দৌড়ে পালান। কিছু দেহ এতই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের চিহ্নিত করাই অসম্ভব। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল স্কুলের বই, ব্যাকপ্যাক।

জেইদ আল হোমরান নামের এক ব্যক্তির দুই ছেলে এই হামলায় নিহত হয়েছে। দুই ছেলের কবর দেখতে এসেছিলেন পাঁচ বছর বয়সী ছোট ছেলেকে নিয়ে। এই সন্তানই এখন শুধু বেঁচে আছে তাঁর। সিএনএনকে তিনি জানান, ঘটনা শুনে তিনি রাগে-ক্ষোভে চিৎকার করছিলেন। তাঁর আশপাশে নারীরা শোকে মাটিতে আছড়ে পড়ছিলেন। প্রত্যেকে তাঁদের শিশুসন্তানের নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন। ঘটনা শুনে তিনি ওই নারীদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে হামলার ঘটনা সত্য হতে পারে না। ওই সময় এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলতে থাকেন, স্কুলবাসের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়েছে।

হামলার পরপর আহত দুই শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ছবি: এএফপি
হামলার পরপর আহত দুই শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ছবি: এএফপি

সিএনএন এই তথ্য প্রমাণের ব্যাপারে সৌদি জোটের মুখপাত্র কর্নেল তুর্কি আল-মালিকির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ইয়েমেনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ইরান-সমর্থিত বিদ্রোহী গ্রুপ হুতি বাহিনী উৎখাত করেছে। বৈধ সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সহায়তায় জোট কাজ করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসরণ করে জোট অভিযান পরিচালনা করছে। বেসামরিক লোকজন যেন মারা না যায়, সেদিকে যতটুকু সম্ভব লক্ষ রাখা হচ্ছে। যেকোনো সাধারণ মানুষের মৃত্যুই দুঃখজনক।

তুর্কি আল-মালিকি আরও বলেন, ঘটনাটি তদন্তাধীন বলে জোটের এ নিয়ে আর কথা বলা ঠিক নয়।

এদিকে সৌদি আরব এ হামলাকে ‘বৈধ সামরিক অভিযান’ উল্লেখ করে বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর কথা অস্বীকার করেছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রেবেকা রেবারিচ সাদা প্রদেশে বোমা হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বেসামরিক মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনার সত্যতা পেন্টাগন যাচাই করেনি। কারণ, সেখানে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নেই। সব পক্ষকেই হতাহত হওয়ার সংখ্যাটা কম রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আহ্বান জানায়।

জাতিসংঘ এ হামলার বিষয়ে পৃথক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে ইয়েমেনে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জাতিসংঘ বারবার এই আহ্বান জানিয়েছে। শুরু থেকে ইয়েমেনের নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আবদু রাব্বু মানসুর হাদিকে সমর্থন দিয়ে হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। তিন বছরে এ যুদ্ধে মৃত মানুষের সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০১৫ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুসারে, এই যুদ্ধে কমপক্ষে ৫ হাজার ২৯৫ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে অন্তত ৮ হাজার ৮৭৩ জন। খাদ্য, চিকিৎসা ও সুরক্ষার অভাবে ইয়েমেনে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।