পাকিস্তানিদের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার চাপে ইমরান খান

গত ২২ জুলাই নির্বাচনী প্রচারের সময় ইমরান খানের ছবি দিয়ে বিলবোর্ড তৈরির পর সেখানেই বসে রয়েছেন শ্রমিকেরা। ছবি: রয়টার্স ফাইল
গত ২২ জুলাই নির্বাচনী প্রচারের সময় ইমরান খানের ছবি দিয়ে বিলবোর্ড তৈরির পর সেখানেই বসে রয়েছেন শ্রমিকেরা। ছবি: রয়টার্স ফাইল

দেশের জনগণের জন্য নানা প্রতিশ্রুতির ডালি খুলে বসেছিলেন তিনি। তবে নিজেই এখন তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। আকাশচুম্বী প্রত্যাশার চাপ নিয়ে এখন ছুটতে হচ্ছে পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী, একসময়ে ক্রিকেট তারকা ইমরান খানকে।

আজ রোববার রয়টার্সে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের জন্য এক কোটি চাকরি সৃষ্টি এবং বিশ্বে পাকিস্তানের জীর্ণশীর্ণ ভাবমূর্তি কাটানো—এসব নিয়েই এখন জটিল পরিস্থিতির মুখে ইমরান।

গত মাসে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসেছে ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ভোটের আগে অঙ্গীকার করেছিলেন অর্থ লোলুপ অভিজাত শ্রেণির দুর্নীতির মূল উৎপাটন করবেন এবং মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেবেন। তবে তিনি এমন এক সমাজের উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতায় এসেছেন, যেখানে ঘরে-বাইরে পর্বতসমান সমস্যা। রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্কে ফাটল রয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তান এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গেও লড়াই করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে।

ইতিমধ্যে পার্লামেন্টে বিরোধী দলগুলো ইমরান খানের বিরুদ্ধে বড় জোট গঠনের কথা বলছে। তাদের মতে, ইমরান খান দেশের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর ‘পুতুল’। দেশটির প্রধানমন্ত্রীদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে এই বাহিনীর।

বলা হয়ে থাকে, এই নির্বাচনে ইমরান খান ছিলেন সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী। নির্বাচনে তাঁর জয় নিশ্চিত করতে কলকাঠি নেড়েছে সামরিক বাহিনী। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইমরান খান।

বিজয়ীর ভাষণে ইমরান ভারতের প্রতি শান্তির হাত বাড়িয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি উভয়ের জন্য লাভজনক সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রতাপশালী জেনারেলদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন যাবে, এর ওপরই ইমরান খানের পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকা নির্ভর করছে। যদি পররাষ্ট্রনীতি ইস্যুতে ইমরান খানের সঙ্গে জেনারেলদের মতপার্থক্য হয়, তাহলে তাঁর পরিণতিও আগের নেতাদের মতো হবে। যাঁরা কেউ পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারেননি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমের আহমেদ খান বলেন, ‘তাহলে তাঁর ভবিষ্যৎও অন্যদের মতো হবে।’

১৮ আগস্ট পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে প্রেসিড হাউসে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান শপথ নিচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেইনের কাছে। পাকিস্তানের তথ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া ছবিটি প্রকাশ করে রয়টার্স।
১৮ আগস্ট পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে প্রেসিড হাউসে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান শপথ নিচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেইনের কাছে। পাকিস্তানের তথ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া ছবিটি প্রকাশ করে রয়টার্স।

নির্বাচনের পর দেশটি এখন লাগামছাড়া প্রত্যাশার বন্যায় ভাসছে। বিশেষ করে ইমরানের খানের তরুণ সমর্থকেরা বিশ্বাস করেন, ২০ কোটি ৮০ লাখ জনগোষ্ঠীর দেশটিকে ইমরান খান দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধশালী ‘নতুন পাকিস্তান’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন।

পাকিস্তানের ডেইলি টাইমসের সম্পাদক রাজা আহমাদ রুমি বলেন, ‘ইমরান খানের বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাঁর সমর্থক ও ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণ করা। কারণ, তিনি তাদের হাতে প্রায় চাঁদ এনে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’

রাজা আহমাদ আরও বলেন, ‘ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে একটি সাদামাটা ধারণা রয়েছে যে শীর্ষ ব্যক্তি পরিচ্ছন্ন (দুর্নীতিমুক্ত) হলে পুরো ব্যবস্থাপনাই পরিচ্ছন্ন থাকবে। পৃথিবীর আর কোথাও এমনভাবে কখনো ভাবা হয় না।’

গত সপ্তাহে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের সময় ইসলামাবাদের রাস্তাঘাটে পাকিস্তানি পতাকা হাতে মানুষের ঢল নামে। অনেককেই ইমরানের খানের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে বলেন যে তিনি বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরি করবেন এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করবেন। দেশটিতে এখন নিরক্ষর জনগণের সংখ্যা ৪০ শতাংশের ওপরে।

নির্বাচনের সময় ইমরান খানের দলের হয়ে কাজ করা শেখ ফারহাজ (৪০) নামের এক ব্যক্তি বলেন, তিনি তাঁর মেয়েকে বেসরকারি স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। কারণ, তিনি মনে করেন, পাকিস্তানে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন যে দেশটিতে বরাবর বড় দুটি দল নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও ভুট্টো পরিবারের পাকিস্তান পিপলস পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। এবার সেই প্রথা ভেঙে দিয়েছেন ইমরান খান।

রাস্তার পাশে এক পতাকা বিক্রেতা শাহ সুলতান (৩৮) বলেন, ‘ইমরান খানের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। আমরা দরিদ্র মানুষ। আমি ইমরান খানকে ভোট দিয়েছি, কারণ অন্য রাজনীতিকেরা দেশের জন্য কিছুই করেননি।’

তবে বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ইমরানে খানের এই প্রতিশ্রুতিগুলো হোঁচট খাবে। বিশেষ করে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি। গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে ডলার বিপরীতে চারবার রুপির (পাকিস্তানি মুদ্রা) মান কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের রাজস্বঘাটতি ফুলেফেঁপে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এখন প্রায় ৬ শতাংশে ঘোরাফেরা করছে। তবে রাজস্বঘাটতি থাকায় সহজেই অনুমেয় যে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি আরও নেমে যাবে।

ইমরান খানের সরকারকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে চীনের কাছ থেকে আরও ঋণ চাইবে, নাকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হবে। ঋণদাতা দুটি পক্ষই বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁটের কথা বলতে পারে।

নতুন শিক্ষামন্ত্রী সাফকাত মাহমুদ বলেছেন, অর্থনৈতিক সমস্যা থাকার পরও তাঁর দল লক্ষ্য পূরণে কাজ করবে। দলের প্রত্যেকে এটা উপলব্ধি করছেন যে এসব প্রত্যাশা পূরণে সবাইকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হবে।

সাফকাত মাহমুদ আরও বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমরান খানের আপসহীন ভাবমূর্তি সরকারের ওপর সাধারণ জনগণের আস্থা আরও বাড়াবে। এটা আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে কর প্রদানে উৎসাহিত করতে পারবে। দেশটিতে এখন ১ শতাংশেরও কম মানুষ আয়কর দিয়ে থাকে।

ইমরান খানের নতুন সরকার ‘১০০ দিনের কর্মসূচি’ ঘোষণা করেছে। তবে তাঁর দল যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই রয়েছে কর সংগ্রহ ব্যুরোতে সংস্কার আনার লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালিত লোকসান গোনা কর্মসূচিগুলোয় পরিবর্তন আনা। আর এসব প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। সরকারে দুর্নীতি বন্ধ করা অথবা দেশটি থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ-সম্পদ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করাও খুব কম সময়ে করা সম্ভব নয়।