কোরীয় যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষদের পুনর্মিলনের উদ্যোগ

যুদ্ধে আলাদা হওয়ার পর বয়স্ক মানুষেরা স্বজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
যুদ্ধে আলাদা হওয়ার পর বয়স্ক মানুষেরা স্বজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

যুদ্ধের ডামাডোলে তাঁরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। স্বামী-সন্তানের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে ছুটছিলেন লি কিয়াম-সিওম। কোন ফাঁকে চার বছর বয়সী ছেলেকে হারিয়ে ফেলেন। এরপর যুগের পর যুগ কেটেছে। ছেলে বেঁচে আছে কি নেই, তা জানতেন না। তবে জীবনচক্রে কত ঘটনাই না ঘটে! তিনি সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজ পেয়েছেন। ৯২ বছর বয়সী নারী প্রথমবারের মতো তাঁর যুদ্ধে হারিয়ে ফেলা সন্তানকে দেখার জন্য যাত্রা শুরু করেছেন।

আজ সোমবার বিবিসি, রয়টার্স ও এএফপির খবরে বলা হয়, কোরীয় যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওই যুদ্ধে পরিবার ও স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষদের পুনর্মিলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের একটি দল পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে উত্তর কোরিয়ায় যাচ্ছে। ১৯৫০-৫৩ সালের যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের আর দেখা হয়নি।

নিজের বিয়ের ছবিটি উত্তর কোরিয়ায় স্বজনদের উপহার দেওয়ার জন্য সঙ্গে নিয়েছেন লি চুন-জা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
নিজের বিয়ের ছবিটি উত্তর কোরিয়ায় স্বজনদের উপহার দেওয়ার জন্য সঙ্গে নিয়েছেন লি চুন-জা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

যুদ্ধ কোরীয় উপদ্বীপের মানুষকে বিভক্ত করে দিয়েছিল। উত্তর দিকে যাঁরা বাস করতেন, তাঁদের সেখানেই থাকতে হয়েছিল। ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি তাঁদের। দুই কোরিয়ার মানুষদের নিয়ে এর আগেও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে পুনর্মিলন গত তিন বছরে এবারই প্রথম। এই বছরের এপ্রিলে সীমান্ত এলাকায় উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং-উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জেই-ইনের ঐতিহাসিক বৈঠকের ফল হিসেবেই এই পুনর্মিলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে সহায়তা দিচ্ছে রেডক্রস।

দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়েছে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটির বয়স ১০১ বছর।

পুনর্মিলনের জন্য দুই দেশ থেকে ১০০ জন করে নির্বাচিত করা হয়েছিল। তবে নির্বাচিত অনেকে শেষ মুহূর্তে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন। তাঁরা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে জানতে পারেন, যাঁকে দেখার জন্য এই পথ পাড়ি দিতে চাইছেন, তিনি আর বেঁচে নেই। শেষ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া থেকে ৮৩ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৮৯ জনকে এই অনুষ্ঠানের জন্য বাছাই করা হয়েছে। এই যাত্রায় অংশ নেওয়া কারও কারও বয়স এত বেশি যে হয়তো এবারই একে অপরকে শেষবারের মতো তাঁরা দেখবেন।

৯২ বছর বয়সী দক্ষিণ কোরীয় নারী লি কিয়াম-সিওম জানান, যুদ্ধের সময় ছেলের কাছ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধের পর এবারই প্রথম ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তিনি।

ওই নারী বলেন, যুদ্ধের সময় তাঁর স্বামী আতঙ্কে তাঁদের নিয়ে পালাতে শুরু করেন। ওই সময় চার বছর বয়সী ছেলেকে তিনি হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, এমন দিন কখনো আসবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। ছেলে বেঁচে আছে কি নেই, তাও জানতেন না।

মুন হিয়ান-সুক নামের আরেক নারী জানান, তিনি তাঁর ছোট বোনকে দেখতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৯০ বছরের ওপরে। কখন মারা যাই, ঠিক নেই। আমি খুব খুশি যে এবার আমি এই সুযোগ পেয়েছি।’

দুই কোরিয়ার আয়োজনে ১৮ বছর ধরে পুনর্মিলনের এমন ২০টি অনুষ্ঠান করা হয়েছে। যুদ্ধ-সময়ের স্মৃতি যাঁদের আছে, দিনে দিনে তাঁদের বয়স আরও বাড়ছে। তাঁদের জন্য সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এর আগে এমন অনুষ্ঠানগুলোয় ভাই-বোন, বাবা-মা ও সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাৎ এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। তাঁরা একে অপরকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

অনেকের জন্য হয়তো এটাই হবে স্বজনদের সঙ্গে শেষ দেখা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
অনেকের জন্য হয়তো এটাই হবে স্বজনদের সঙ্গে শেষ দেখা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাসে করে এই মানুষদের উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কড়া নিরাপত্তা প্রহরার মধ্য দিয়ে কুমগ্যাং পর্বত এলাকায় পর্যটন রিসোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁদের। তাঁরা তিন দিন উত্তর কোরিয়ায় থাকতে পারবেন। এই তিন দিনের প্রতিদিন ১১ ঘণ্টা করে তাঁরা পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। তবে তাঁদের এই সাক্ষাতের সময়টুকু কড়া নজরদারিতে রাখা হবে। অনেকে স্বজনদের জন্য পোশাক, ওষুধ ও খাবার উপহার হিসেবে নিয়ে গেছেন।

৭৬ বছর বয়সী লি সু-নাম জানান, তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের জন্য বাড়িতে তৈরি পুষ্টি পরিপূরক, হজমশক্তি বৃদ্ধি ও মাথাব্যথানাশক ওষুধ নিয়েছেন সঙ্গে।

বয়স্ক মানুষগুলোর জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য দলটির সঙ্গে কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন।

উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দুই নেতা গত মে মাসে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে এই পারিবারিক পুনর্মিলনের ব্যাপারে সম্মত হন।

শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশ উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বহুল আলোচিত বৈঠক অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়া দূতিয়ালির ভূমিকা রেখেছিল। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ইস্যুসহ দ্বিপক্ষীয় ব্যাপারে গত জুন মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মধ্যে বৈঠক সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হয়।