ভেনেজুয়েলা ধুঁকছে

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো গত বুধবার রাজধানী কারাকাসে ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে বক্তব্য দেন। ছবি রয়টার্স
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো গত বুধবার রাজধানী কারাকাসে ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে বক্তব্য দেন। ছবি রয়টার্স

গত বুধবার ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ভেনেজুয়েলা। এই ভূমিকম্পের কাঁপুনি টের পাওয়া গেছে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায়ও। ভেনেজুয়েলার জনপ্রিয় রম্য পত্রিকা বলছে, দুই টেকটনিক প্লেট ভেনেজুয়েলা ছাড়ার দৌড়ে ঠোকাঠুকি বেধে গেছে, তাই এই ভূমিকম্প। সত্যিকার অর্থে, এই শ্লেষ ভেনেজুয়েলার জন্য কঠিন বাস্তবতা।

ভেবে দেখুন, মাসের প্রথম দিনে মোটা অঙ্কের টাকা আছে আপনার ব্যাংকে, মানিব্যাগে কিংবা পার্সে। বাড়ি ফেরার পথে ট্রাফিকে আটকে যখন দরদর করে ঘামছেন, তখনই মুঠোফোনে এক অনাহূত খুদে বার্তা। বাড়ি ফেরার পথে টয়লেট পেপার নিয়ে আসতে হবে। দোকানে গিয়ে আপনার মাথায় বাজ পড়তে পারে। এক রোল টয়লেট পেপার কিনতে আপনার মোটা বেতনের প্রায় সবটাই বেরিয়ে যাচ্ছে। অথবা এই টয়লেট পেপার কিনতেই শরণাপন্ন হতে হচ্ছে কালোবাজারির। প্রায় ৮০,০০০% মূল্যস্ফীতির ভেনেজুয়েলায় বাস্তবতা এমনটাই।

মুদ্রাস্ফীতি পাগলা ঘোড়ায় ভর করে, ভেনেজুয়েলার টাকার এতই অমূল্য হয়েছে, সেটা দিয়ে আর কিছু কেনাকাটা করা যায় না। দোকানে ওষুধ বা খাবার কিছুই নেই। কিনতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই বস্তা বস্তা টাকা খরচ করতে হবে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ভেনেজুয়েলার ১৮-২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যার অর্ধেক ছেড়ে চলে যেতে চান জন্মভূমি। পিছিয়ে নেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিও, তাদের ৫৫ শতাংশ ছাড়তে চান স্বদেশ। কারণ হিসেবে দেশের অর্থনীতিকেই দুষছেন দেশ ছাড়তে চাওয়া মানুষের তিন ভাগের দুই ভাগ।

সৌদি আরবের থেকেও বড় তেলের মজুত থাকার পরও ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির এই দুর্দশা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। এই অর্থনীতি, লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরণার্থী পরিস্থিতি তৈরি করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংগঠনের (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন, আইওএম) মতে, ১ দশমিক ৬ মিলিয়নের বেশি অধিবাসী দেশছাড়া। এই হিসাব হয়েছে তাও এক বছরপ্রায়।
স্রেফ কলম্বিয়াতেই ২০১৮ সালের জুন মাসের হিসাবে ভেনেজুয়েলান আছেন ১ মিলিয়ন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এ বছরের প্রথম সাত মাসে ১ লাখ ৩৫ হাজার আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন পেয়েছে। সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার ৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৪ মিলিয়নই দেশছাড়া। যদি সোজা ভাষায় বলা যায়, প্রতি ১০ জন ভেনেজুয়েলার নাগরিকের মধ্যে ১ জন পরবাসী হয়, এই সংখ্যা ধীরে ধীরে সিরিয়ার ৬ মিলিয়ন শরণার্থী ছাড়িয়ে যাবে।

এসবের শুরু ১৯৯৯ সালে হুগো চাভেজের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর। দেশের সব রাজনীতিবিদ চোর এবং নিষ্কর্মা, এই ইশতেহারে ভেনেজুয়েলার জনগণের মন জিতে নেন চাভেজ। ফলে ১৯৯৯ সালে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রেসিডেন্ট ভেনেজুয়েলার ক্ষমতায় বসেন।

সে সময় ভেনেজুয়েলার ৬০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। কাজের সুযোগ বাড়াতে সরকারি তেল কোম্পানি পিডিভিএসএতে গণহারে নিয়োগ শুরু হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানে চাভেজ প্রায় দ্বিগুণ লোক নিয়োগ দেন। ফলে ২০০৬ সাল নাগাদ এর কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৫ হাজার।

দেশের বিশাল তেলের মজুত কাজে লাগান চাভেজ। লোকের পকেটে তখন টাকা, নানান সরকারি কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যবস্থাও আছে। সেটা করতে ধীরে ধীরে সব ধরনের বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করা শুরু করেন চাভেজ। বাদ যায়নি বাড়ির নিচে করা এক ছোট মুদিদোকানও। সেবা থেকে শুরু করে কৃষি—সবকিছুই রাষ্ট্রের অধীনে আনেন চাভেজ। তাঁর চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন, বলিভিয়ান বিপ্লব।

শুরু থেকেই এই নব্য বলিভিয়ান বিপ্লবের সহযোদ্ধা ছিল কালো স্বর্ণ; ভেনেজুয়েলার বিশাল তেলের মজুত। এই তেলের মজুতের বলে বলীয়ান হয়ে, লাগে টাকা দেবে গৌরি সেন মনোভাবে বেতন বাড়িয়েছেন চাভেজ। তেলের বিক্রিও বাড়ছে, তেলে খুশি হয়ে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

হুগো চাভেজ স্বদেশের দারিদ্র্য কমিয়ে ৩০ শতাংশে নিয়ে আসেন। জনমানসে আনন্দ থাকলেও, কিছু নড়বড়ে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ভেনেজুয়েলার ভবিষ্যতের কফিনে পেরেক ঠোকা শুরু করে।

কৃষি থেকে শুরু করে মুদিদোকান এমনকি তেল উত্তোলন কোম্পানি—সবকিছুই রাষ্ট্রায়ত্ত করে ফেলায় বছরের পর বছর ঘাটতি বাজেট দিতে হয়েছে চাভেজ সরকারকে। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেননি প্রেসিডেন্ট। তেলের বাজার চড়া, যত ঘাটতি আছে তেল বিক্রির টাকা দিয়ে মিটিয়ে ফেলা যাবে।

ধীরে ধীরে ডলারের বিপরীতে দাম কমতে থাকে বলিভারের। কালোবাজারি ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে থাকে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির নিচে। কৃষির দিকে মনোযোগ সরতে থাকে সরকারের। যেহেতু তেল বিক্রি করেই ধুম-ধাড়াক্কা অর্থনীতি চলছে, বাকি সব চুলোয় যাক। সবকিছু রাষ্ট্রায়ত্ত হোক। সব বাণিজ্য, কৃষি, সেবা রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়ায় কর দেওয়ার কেউ থাকছে না।

এর মাঝে ক্যানসারে মারা যান চাভেজ। ক্ষমতায় আসেন নিকোলাস মাদুরো। তবে চাভেজের মতো কারিশমা ছিল না তাঁর। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে মন দেন মাদুরো। নয়তো বলিভার বিপ্লব ধ্বংস করে দিতে পারে পুঁজিবাদী শক্তি। বিরোধী দল দমনে মন দেন মাদুরো। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের চাকরিচ্যুত করে মোসাহেবদের ক্ষমতায় বসান। এমন সময়েই বিশ্বে তেলের দাম কমতে থাকে, সময়টা ২০১৪।

তেলের দাম কমতে থাকায় সব কৃচ্ছ্রসাধন ভেস্তে যেতে থাকে। দেশে কর দেওয়ার মতো ব্যক্তিগত সেবা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না থাকার সর্বনাশ এবার টের পেতে থাকে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি। একদিকে কর দেওয়ার মতো কেউ নেই, অন্যদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে ধীরে ধীরে দুর্নীতি, চুরি বেড়েছে রাজনীতিকদের মাঝে। নিজের ক্ষমতা বাড়াতে পুলিশ, সামরিক বাহিনী আর গোয়েন্দা সংস্থাকে ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের সাফ কবলা লিখে দিয়েছেন মাদুরো।

২০১৭ সালের দিকে মাদুরোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে ভেনেজুয়েলার জনগণ। সেই বিক্ষোভ দমাতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ব্যবহার করেন মাদুরো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলায় ৩৪১ জন রাজবন্দী আছেন। যাঁদের সবাই মাদুরো সরকারবিরোধী ছিলেন। মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে ১৪১ জনেরও বেশি মানুষ। দারিদ্র্যের পরিমাণ এতই বেড়েছে, ২০১৭ সালে ভেনেজুয়েলার মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ শতাংশ।
জ্বলন্ত অঙ্গারে বাতাস দিতেই যেন মাদুরো বলিভারের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে, মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার বদলে লাগাম ছিঁড়ে গেছে যেন। এক টুকরো রুটির জন্য একে অপরকে ছুরি মারার ঘটনাও ঘটছে ভেনেজুয়েলায়। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, সন্ত্রাস সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলা এখন রাষ্ট্রনায়কদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠছে। কী করতে হবে সেটার নয়; বরং কী করতে নেই সেটার। ভূমিকম্পের তীব্রতা নিয়ে দুশ্চিন্তা ভেনেজুয়েলায় আসলেও বিলাস।