এক বাবার বুকে তিন শিশুপুত্র হারানোর হাহাকার

নিহত শিশুদের লাশের কফিনের সারি। ইয়েমেন, ৯ আগস্ট। ছবি: রয়টার্স
নিহত শিশুদের লাশের কফিনের সারি। ইয়েমেন, ৯ আগস্ট। ছবি: রয়টার্স

ছোট্ট আলী। কয়েক দিন ধরেই বায়না ধরেছে, তিন ভাই মিলে স্কুল থেকে ঘুরতে যাবে। বাবা জায়েদ তায়েবের মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। কারণ, ইয়েমেনের যে পরিস্থিতি, হুতি বিদ্রোহী ও সরকারের সমর্থিত সৌদি জোটের মধ্যে হরদম যুদ্ধ লেগে আছে। যেকোনো মুহূর্তে যেতে পারে প্রাণ।

কিন্তু ছেলের বায়নার কাছে অবশেষে বাবাকে হার মানতেই হয়। স্কুলের অন্য একটি গ্রুপ ভ্রমণ শেষে একই পথে নিরাপদে ফিরে আসার পর জায়েদ ছেলেদের পাঠাতে রাজি হন।

ছেলেদের ঘুরতে যাওয়ার দিনের সকালটা স্মরণ করে জায়েদ বলেন, ‘আমি সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, আমার তিন ছেলে নতুন জামাকাপড় পরে প্রস্তুত। আমি এমন একটা ভাব করলাম যে তারা কোথায় যাচ্ছে আমি কিছুই জানি না। ছেলেরা খিলখিল করে হেসে উঠল। আমাকে মনে করিয়ে দিল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী মানুষ মিথ্যা বলে না। কারণ, তারা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার পর আমি তাদের বেড়াতে নিয়ে যাব বলে কথা দিয়েছিলাম।’

হাসপাতালের বিছানায় আহত এক শিশু। ইয়েমেন, ৯ আগস্ট। ছবি: রয়টার্স
হাসপাতালের বিছানায় আহত এক শিশু। ইয়েমেন, ৯ আগস্ট। ছবি: রয়টার্স

যাওয়ার আগে তিন সন্তানই জায়েদকে জড়িয়ে ধরে। এরপর তারা বাসে উঠে বসে। জায়েদ বলেন, ‘বাস ছেড়ে দেওয়ার সময় ওরা আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিল। আমিও বলেছিলাম, আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছে ।’

এরপর জায়েদ ঘুরে বাড়ির পথে পা বাড়ান। ১০০ থেকে ১৫০ মিটারের মতো গেছেন, এমন সময় বিকট শব্দ। তিনি দেখেন, বাসটি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত। চারপাশে ধোঁয়া ও ধ্বংসস্তূপ।

জায়েদ বলেন, ‘আমার সামনে প্রথম যে লাশটি পড়ল, তাকেই আমি কোলে তুলে নিলাম। শিশুটির মুখ তখনো মাটির দিকে। যখন মুখটি ঘুরিয়ে দেখলাম, তখন আমরা দুনিয়া শেষ। এ যে আমার ১০ বছরের ছেলে আহমেদ!’

গত ৯ আগস্ট ইয়েমেনের সাদা প্রদেশে একটি স্কুলবাসের ওপর সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বিমান হামলা চালায়। এতে ৫১ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ৪০ জন শিশু। আহত হয় ৭৯ জন। সিএনএনের খবরে বলা হয়, মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কন্ট্রাক্টর লকহিড মার্টিনের তৈরি ২২৭ কেজি ওজনের লেজার রশ্মিচালিত এমকে ৮২ বোমা ব্যবহার করা হয় হামলায়।

নিহত শিশুদের কবরে দোয়া পাঠ করছে আরেক শিশু। ইয়েমেন, ৪ সেপ্টেম্বর।  ছবি: এএফপি
নিহত শিশুদের কবরে দোয়া পাঠ করছে আরেক শিশু। ইয়েমেন, ৪ সেপ্টেম্বর। ছবি: এএফপি

হুতি বিদ্রোহীদের দাবি, জেনেশুনে শিশুদের লক্ষ্য করেই এ হামলা চালানো হয়। জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য ঠিক ছিল, কিন্তু সময় নির্ধারণে গড়বড় হয়েছে।

সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে দুই পক্ষই লড়ে যাচ্ছে। শিশুদের হত্যা ও বিকলাঙ্গ করে দেওয়ার দায়ে গত বছর জাতিসংঘ সৌদি আরবকে কালো তালিকাভুক্ত করে।

আর হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সাধারণ মানুষকে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করে, শিশু সেনা নিয়োগ দেয়।

কবরের ওপর প্রতিটি শিশুর ছবি। ইয়েমেন, ৪ সেপ্টেম্বর।  ছবি: এএফপি
কবরের ওপর প্রতিটি শিশুর ছবি। ইয়েমেন, ৪ সেপ্টেম্বর। ছবি: এএফপি

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের দুর্ভোগের বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই চলমান যুদ্ধে ২ হাজার ২০০ শিশু নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘ এ হামলার বিষয়ে পৃথক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে ইয়েমেনে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জাতিসংঘ বারবার এই আহ্বান জানিয়েছে। শুরু থেকে ইয়েমেনের নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আবদু রাব্বু মানসুর হাদিকে সমর্থন দিয়ে হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। তিন বছরে এ যুদ্ধে মৃত মানুষের সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০১৫ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুসারে, এই যুদ্ধে কমপক্ষে ৫ হাজার ২৯৫ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে অন্তত ৮ হাজার ৮৭৩ জন। খাদ্য, চিকিৎসা ও সুরক্ষার অভাবে ইয়েমেনে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।

জায়েদের শোয়ার ঘরের দেয়ালে এখন ঠাঁই পাচ্ছে ১৩ বছরের ইউসুফ, আহমেদ এবং ৯ বছরের আলীর ছবি। প্রতিটি ছবির নিচে তাদের মৃত্যুর তারিখ লেখা। আরও লেখা ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট দাহয়ানে শিশুদের ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ডে তারা শহীদ হয়েছে।

জায়েদের ঘরে শুধু এখন পাঁচ বছরের ছেলে মোহাম্মদ। তার বয়স খুব কম হওয়ায় সেদিন তাকে যেতে দেননি জায়েদ। গেলে আজ জায়েদ ও তাঁর স্ত্রীর দুনিয়াটা পুরোই শূন্য হয়ে যেত। জায়েদ বলেন, তাঁর তিন ছেলে বুদ্ধিমান, ভদ্র-নম্র ও মেধাবী ছিল। এখন তারা বেহেশতে আছে।