শিক্ষাব্যবস্থায় সিঙ্গাপুরে নীরব বিপ্লব

সিঙ্গাপুরের নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (সিম)। ছবি: রয়টার্স
সিঙ্গাপুরের নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (সিম)। ছবি: রয়টার্স

‘ধর তক্তা, মার পেরেক’—প্রবাদবাক্যটি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মেলে কি না, তা আলোচনাসাপেক্ষ। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর ওজনদার শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়াকে অনেকে এভাবেই তুলনা করতে ভালোবাসেন। এখানে অভিভাবকদের ‘উৎসাহে’ শিক্ষার্থীদের ‘তক্তা’ বানানোর কাজটি করেন শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীরা যেন পড়ার টেবিল থেকে উঠে ‘অন্য কিছুতে’ মনোযোগ দিতে না পারে, সে চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না। শিশু অবস্থা কাটিয়ে ওঠামাত্র শুরু হয় এই প্রক্রিয়া। লক্ষ্য একটাই, আকর্ষণীয় চাকরি ধরতে উপযোগী করে তোলা। চাকরির বাজারে যোগ্য প্রার্থী হওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি ‘অতিরিক্ত শিক্ষা’ নিতে হয়। দৌড়াতে হয় এক শিক্ষক থেকে আরেক শিক্ষকের কাছে। অনেকে তাই এই শিক্ষাব্যবস্থাকে আরেকটি শব্দেও ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করেন, তা হচ্ছে ‘প্রেশারকুকার’।

এতটুকু পড়ে যাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন, তাঁরা শুনে অবাক হবেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষাব্যবস্থার এই হাল। ভালো চাকরির বাজার সব দেশেই সংকুচিত। তাই ভালো চাকরি পেতে দিন-রাত পড়াশোনার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। ভবিষ্যতের জীবন গড়তে সবচেয়ে বেশি চাপের শিকার হয় স্কুলশিক্ষার্থীরা। তবে এই অবস্থার মধ্যেও কোনো কোনো দেশ শিক্ষাব্যবস্থায় নানান সংস্কার এনে সুনাম কুড়িয়েছে। সেরা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় নানান সংস্কার এনে আলোচনায় রয়েছে—এমনই একটি দেশ সিঙ্গাপুর।

ইকোনমিস্ট সাময়িকীর সাম্প্রতিক সংখ্যায় শিক্ষাব্যবস্থায় সিঙ্গাপুরের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ওপর ‘অতিরিক্ত’ চাপ দেওয়ার রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে সিঙ্গাপুর। পশ্চিমা বিশ্বের অজান্তে সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থায় নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। শুধু পড়াশোনা নয়, শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে ব্যাপক সংস্কার আনা হয়েছে। তিনটি বিষয় তুলে ধরে এতে বলা হয়, সিঙ্গাপুরের কাছে বিশ্বের শেখার আছে। ওই নিবন্ধে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের অতিরিক্ত চাপ দেওয়ার বিষয়টিও তুলে আনা হয়েছে। চীনের উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, চীনে লেখাপড়া মানেই ‘তুমি শুধু দিন-রাত পড়ে যাও’।

বাংলাদেশের কথাই যদি ধরা যায়, এখানে একজন স্কুলশিক্ষার্থীকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পড়ার চাপে থাকতে হয়। রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা মাহমুদা আক্তার জানান, তাঁর ছোট ছেলে রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি মিডিয়ামে নবম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলে ভালো পড়ানোর পরও এসএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তাঁর ছেলে পাঁচজন শিক্ষকের কাছে ব্যাচে পড়ে এখন। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিতে আরও ভালো ফলের জন্য এই বাড়তি টিউশন নিচ্ছে। এ ছাড়া বাংলায় দুর্বলতা থাকায় বাংলা বিষয়েও আলাদা শিক্ষক রেখেছেন। বাংলায় এক হাজার টাকা এবং বাকি চারটি বিষয়ে দেড় হাজার টাকা করে ব্যাচে পড়তে হয় তাঁর ছেলেকে।

সিঙ্গাপুরের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ছবি: এএফপি
সিঙ্গাপুরের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ছবি: এএফপি

মাহমুদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন ভালো ফলের জন্য প্রতিযোগিতা হয় তুমুল। সবাই চায়, তাঁর সন্তান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকুক। আমার ছেলের সহপাঠীদের মধ্য দু-একজন ছাড়া সবাই স্কুলের বাইরে বাড়তি টিউশন নেয়। অনেকে ব্যাচে পড়ে। বাড়িতেও গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে। এর মানে এই নয় যে স্কুলে পড়ায় না। ছেলে জানায়, অনেক কিছু তার আরও ভালো করে জানা দরকার।’

মাহমুদা আক্তার জানান, ছেলে দিবা শাখায় পড়ায় স্কুল শুরু হয় বেলা পৌনে একটায়। স্কুলে যাওয়ার আগে সকাল আটটা থেকে নয়টা ও নয়টা থেকে দশটা ব্যাচে পড়ে। সপ্তাহে এক দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় স্কুল ছুটির পর ব্যাচে পড়ে। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ছেলেও স্কুল ও কলেজজীবনে এভাবে ব্যাচে পড়েছেন বলে তিনি জানান।

ইকোনমিস্টে বলা হয়, সিঙ্গাপুরেও শিক্ষার্থীদের ওপর পড়াশোনার চাপ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে সিঙ্গাপুর দাবি করেছে, শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক ও বাড়তি পরীক্ষার চাপ কমিয়ে আনা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পরিবর্তন আনা হচ্ছে পরীক্ষাপদ্ধতিতেও।

এ বছর শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি ‘ওয়ার্ল্ড টপ ২০ প্রজেক্ট’ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তথ্য তুলে ধরে। সেরা ২০টি দেশ হচ্ছে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, চীন, জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ইসরায়েল, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, স্পেন, সুইজারল্যান্ড। এই জরিপে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলপর্যায়ে সিঙ্গাপুর প্রথম বলে জানানো হয়।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্টের এক খবরে বলা হয়েছে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে। দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ধারণে প্রতিযোগিতামূলক ১২টি স্তম্ভ অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে দীর্ঘ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা ও শ্রমবাজার সক্ষমতা অন্যতম। এই তালিকায় শীর্ষ ১১টি দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুরকে চতুর্থ স্থানে দেখানো হয়েছে। সিঙ্গাপুর সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টে (পিসা) সিঙ্গাপুর অবিশ্বাস্য রকমের স্কোর করেছে। এই তালিকায় শীর্ষ তিনটি দেশ হচ্ছে ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম।

এক নজরে সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা
এক নজরে সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা

সিঙ্গাপুরে শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার
সিঙ্গাপুরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে, তিন বছর বা এর কম বয়সী শিশুদের প্রি-নার্সারি স্কুলে ভর্তি করা হয়। এরপর নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনের দুই ধাপ পেরিয়ে সাত বছর বয়সে শিশুরা প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়। প্রাথমিক স্কুলে ছয় বছরের শিক্ষাক্রম শেষ করে প্রবেশ করতে হয় মাধ্যমিক পর্যায়ে। নিম্নমাধ্যমিকে দুই বছর এবং উচ্চমাধ্যমিকে দুই থেকে তিন বছর, অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর চার থেকে পাঁচ বছর লাগে। এরপর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে জুনিয়র কলেজ বা পলিটেকনিক বা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেন দুই থেকে তিন বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে পড়তে হয় তিন থেকে পাঁচ বছর।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অল্প কিছু বন্ধু, আর অল্প প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ১৯৬৫ সালে দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর স্বাধীন হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এরপরও এত কম সময়ে দেশটি কীভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য ও অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত হলো? এ প্রশ্ন বিশ্বজুড়েই ঘুরপাক খায়। এই কৌশল জানাতে গিয়ে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ একটি কথাই বলেছিলেন, ‘সিঙ্গাপুরের উন্নয়নে একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল এর জনগণ।’

সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থাকে আজ বিশ্বসেরা বলা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টের (পিসা) ত্রিবার্ষিক পরীক্ষায় সিঙ্গাপুর একচেটিয়া শীর্ষস্থান দখল করে আসছে। বিভিন্ন দেশের ১৫ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের গণিত, রিডিং ও বিজ্ঞান—এই তিন শাখায় পরীক্ষা নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের সেরা স্কুলগুলো থেকে বেরিয়ে আসা গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্বের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

এই দ্বীপরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে। অন্য দেশগুলো শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে নিরুত্তাপ। সিঙ্গাপুর নিজস্ব রীতি অনুসরণ করে শিক্ষা দিয়ে থাকে। ক্লাসে শিক্ষকই নেতৃত্ব দেন। তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এই পদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ করেন অনেক সংস্কারক। তাঁদের মতে, শিশুদের নিজেদের শিক্ষার জন্য আরও ‘প্রগতিশীল’ শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন। যদিও আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, সরাসরি নির্দেশনা জ্ঞান বিতরণের জন্য প্রকৃতপক্ষেই একটি ভালো পদ্ধতি।

সিঙ্গাপুর এখন চাপ কমিয়ে সৃজনশীলতা বাড়াতে শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার আনতে যাচ্ছে। বিশ্বের জন্য তারা তিনটি বিষয় নজির হিসেবে রাখছে।

যেখানে অন্য দেশগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সমন্বয়হীনতার মাধ্যমে সংস্কার নিয়ে আসছে, সেখানে সিঙ্গাপুর পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ধরেই ঝাঁকুনি দিতে চাইছে। শিক্ষা গবেষণায় বড় বিনিয়োগ করছে। পরীক্ষিত সংস্কারগুলোই তারা প্রয়োগ করছে। স্কুলগুলোয় কীভাবে নতুন ধারণা প্রয়োগ করা যেতে পারে,তাতে গভীর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যবই, ওয়ার্কশিট উন্নয়নে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে স্বতন্ত্র শিক্ষাদান পদ্ধতি। অঙ্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কম পাঠ্যসূচির মধ্য দিয়ে পুরো ক্লাস যেন এগিয়ে যেতে পারে,সেটা নিশ্চিত করা হয়। তুলনামূলকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বাড়তি ক্লাস করানো হয়। ২০১৬ সালের যুক্তরাজ্যের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরের এমন সব ব্যবস্থা তাদের ফলাফল উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

তবে তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হচ্ছে চৌকস শিক্ষক গড়ে তোলা। সিঙ্গাপুরে আধুনিক সব পদ্ধতির বিষয়ে একজন শিক্ষক বছরে ১০০ দিনের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। সরকারও তাদের ভালো ভাতা দেয়। মাঝারি মানের শিক্ষক দিয়ে কমসংখ্যক শিক্ষার্থীদের ছোট ক্লাসে শিক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে বড় ক্লাসে দক্ষ শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টিতে সেখানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেরা শিক্ষকেরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পান এবং প্রচুর বোনাস পান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের সমানই সরকারি শিক্ষকেরা বেতন পান। বছর শেষে তাঁদের পারফরমেন্স যাচাই করা হয়।

দেশটির অর্থমন্ত্রী এনথুসেস হেংসুইকিট, যিনি ২০১১-১৫ সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের শুধু স্মার্ট হতে শিক্ষা দেওয়া হয় না, তাদের ভালো মানুষ হতেও শিক্ষা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে পরীক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যসূচিতে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। ছবি: প্রথম আলো।
বাংলাদেশে পরীক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যসূচিতে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। ছবি: প্রথম আলো।

সিঙ্গাপুরে ধাপে ধাপে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষায় সংস্কার আনা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এসেছে, তা হচ্ছে পরীক্ষার ওপর চাপ কমানো। দেশটিতে পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জনকারীদের নাম প্রকাশ করা হয় না। ভালো স্কুলগুলোয় ভর্তির জন্য মানদণ্ড আরও বাড়ানো হয়েছে। ২০২১ সালে যারা প্রাথমিক স্কুল পাস করে বের হবে, তাঁদের নম্বরের পরিবর্তে শুধু গ্রেডই জানানো হবে।

দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক উং সিউ হুং বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাৎক্ষণিক প্রশ্ন দেওয়া হচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক চিন্তাভাবনায় উৎসাহিত করার জন্য। শুধু একাডেমিক পারফরমেন্স নয়, শিক্ষার্থীদের সামাজিক উন্নয়নের ওপরও নম্বর দেন শিক্ষকেরা।

তবে চলমান এসব সংস্কারের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় চাপ দেওয়ার বিষয়টি থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি সিঙ্গাপুর। অনেক সমালোচকদের মতে, সংস্কার হলেও সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতা নেই। কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করা কঠিন হবে সিঙ্গাপুরের জন্যও। অনেক শিশু স্কুলের পর টিউশন নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মা-বাবাই শিক্ষার্থীদের ভালো ফলের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। প্রাথমিক স্কুল ছাড়ার সময় ১১-১২টি পরীক্ষা দিতে হয়, সেটাও চাপে ফেলে শিক্ষার্থীদের। ভালো ফল যারা করে, তারাই ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়, তারই বিদেশে পড়ার সুযোগ পায়, তারাই সরকারি ভালো চাকরি পায়। এ সবকিছু প্রভাব ফেলে শিক্ষার্থীদের ওপর।

সংস্কার বাংলাদেশেও হয়, পরিবর্তন কী এসেছে?
বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থায় সময়ে সময়ে পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনসহ কিছু সংস্কার আনা আনা হয়েছে। তবে সেসব সংস্কারের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। কারও কারও মতে, নতুন পদ্ধতিতে নম্বর বেশি বা পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান উন্নত হয়নি।

আজিমপুরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাতি শাখার ইংরেজির শিক্ষক সাইফুল ইসলামের মতে, পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর পরিবর্তন আনা জরুরি। ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমাতে হবে অথবা পাঠদানের সময় বাড়াতে হবে।

সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা সৃজনশীলতার কথা বলে থাকি। তবে বাস্তবে এর প্রয়োগ সেভাবে দেখা যায় না। শুধু ইংরেজির বিষয়ে যদি বলি, লেটার, প্যারাগ্রাফ—সেই গৎবাঁধা বিষয়বস্তুর মধ্যেই আটকে আছে। শিক্ষার্থীরা জানে, পাঁচটি মুখস্থ করলে একটি কমন পড়বে পরীক্ষায়। এসব বিষয়বস্তুতে যদি পরিবর্তন আনা যায় এবং এভাবে কমন পড়ার নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিজে থেকে লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হবে। এ ছাড়া পাঠ্যসূচিতে ঘন ঘন পরিবর্তন আনা হয়, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে নির্দিষ্ট একটি মানে স্থির থাকা যায় না।’

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ক্লাসে সময় থাকে আধা ঘণ্টা। শিক্ষার্থী থাকে ৮০ জন। একজন শিক্ষকের পক্ষে ওই সময়ের মধ্যে এত শিক্ষার্থীকে সবকিছু শেখানো সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে হয় একটি ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমাতে হবে, নয়তো ক্লাসের সময় বাড়াতে হবে।

শিক্ষার্থীদের বাড়তি টিউশন নেওয়ার বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মানসিক প্রবণতা রয়েছে, অতিরিক্ত কিছু পেতে চাই। অভিভাবকেরাই চান, তাঁর ছেলেমেয়ে ক্লাসের বাইরে ওই বিষয়ে আরও বেশি জানুক। তাঁরা নিজেরাই সন্তানদের শিক্ষকদের কাছে টিউশন নিতে পাঠান। কোনো কোনো শিক্ষক হয়তো শিক্ষার্থীদের টিউশন নিতে বাধ্য করেন। সেটা পাঁচ ভাগও হবে না। এটা দিয়ে সব শিক্ষকের বিচার করা যায় না।’