ইদলিবে ইতি টানছে সিরিয়া সংকট?

ইদলিবে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে আছে জঙ্গিগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-সাম (এইচটিসি)। ছবি: এএফপি
ইদলিবে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে আছে জঙ্গিগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-সাম (এইচটিসি)। ছবি: এএফপি

ইদলিব জ্বলছে। এটাকেই সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। একসময় এই মুকুট ছিল আলেপ্পোর। ২০১৬ সালে এখানে বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর তুমুল লড়াই হয়। তখন শত শত বেসামরিক লোকের সঙ্গে বিদ্রোহীদের অনেকে ইদলিবে আশ্রয় নেয়। অবশ্য ২০১৫ সালেই বিদ্রোহীরা এই প্রদেশ দখলে নিয়েছিল।

জাতিসংঘের হিসাব মতে, ইদলিবে বর্তমানে ১০ লাখ শিশুসহ ৩০ লাখের মতো লোকের বসবাস। জাতিসংঘের বরাতে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, আসাদ ও তাঁর মিত্র রাশিয়া বিমান হামলায় কমপক্ষে নয় লাখ লোক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক দপ্তরের (ওসিএইচএ) সমন্বয়ক মার্ক লোকক বলেছেন, গত কয়েক দিনের বিমান হামলায় ৩০ হাজার লোক ইদলিব ছেড়েছেন এবং আরও আট লাখের মতো ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন।

সিরীয় যুদ্ধে ইদলিবের কেন এত গুরুত্ব
ধারণা করা হচ্ছে, গত সাত বছরের চলমান সিরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি ইদলিবের এই লড়াইয়ে শেষ হতে যাচ্ছে। এরপর যে অঞ্চলগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে আছে, সেগুলো ছোট ও কৌশলগত দিক থেকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ।

ইদলিবের বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের একটি ক্যাম্পে শিশুসহ এক নারী। ছবি: এএফপি
ইদলিবের বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের একটি ক্যাম্পে শিশুসহ এক নারী। ছবি: এএফপি

এই যুদ্ধ মূলত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখার লড়াই। ইদলিবে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-সাম (এইচটিসি) আত্মসমর্পণে বিশ্বাসী নয়। তাদের দর্শনেই আছে ‘আত্মসমর্পণ নয়, শহীদ হওয়া’। এদের পেছনে আল-কায়েদার সমর্থন রয়েছে। পাশাপাশি আসাদবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রও বসে নেই। ৩ সেপ্টেম্বর এক টুইটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন, মানবতার বিরুদ্ধে এ ধরনের হামলা চলতে দেওয়া যায় না। ইতিমধ্যে আসাদবিরোধী জোটের আরেক সদস্য জার্মানি ইদলিবে হামলার জবাব দেওয়ার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছে।

কিন্তু সিরিয়ার সরকারের এক কথা। সন্ধিতে কাজ না হলে যুদ্ধই সংকটের একমাত্র সমাধান। সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ মুয়াল্লেম সম্প্রতি বলেছেন, এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য ইদলিব ‘স্বাধীন’ করা। ইতিমধ্যে ইদলিব বিষয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর তেহরানে রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের প্রেসিডেন্টরা বৈঠক করেছেন। আসাদ সরকারের মিত্র বলে পরিচিত এই নেতারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁর চাক্ষুষ কোনো প্রতিফলন এখন পর্যন্ত অবশ্য দেখা যাচ্ছে না।

ইদলিবে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অবস্থান
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইদলিবে অবস্থানরত বিদ্রোহীরা একক কোনো গোষ্ঠীর নয়। এমনকি মতাদর্শগতভাবেও পরস্পরবিরোধী। তবে তারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সম্মিলিতভাবে ইদলিব নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। নানা হিসাব মতে, ইদলিবে এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্য ৩০ হাজার থেকে ৭০ হাজার। এরা অত্যাধুনিক যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী। এইচটিএস নিয়ন্ত্রণ করছে ৬০ শতাংশ এলাকা। এই গোষ্ঠীর সদস্যদের অনেকেই বিদেশি নাগরিক।

সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও রুশ বিমানবাহিনীর টানা হামলায় ইদলিবের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ছবি: এএফপি
সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও রুশ বিমানবাহিনীর টানা হামলায় ইদলিবের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ছবি: এএফপি


এইচটিএসের মোকাবিলায় অনেকে
শুধু সিরিয়া আর তার প্রকাশ্য মিত্র রাশিয়াই নয়, ইদলিবের দ্বিতীয় শক্তিশালী জোট ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টও (এনএলএফ) এইচটিএসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যাচ্ছে। এনএলএফ হলো তুরস্ক-সমর্থিত এমন একটি জোট, যাতে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির ব্যানারে কার্যক্রম চালানো কয়েকটি ছোট দলসহ ইসলামি কট্টরপন্থী দল আহরার আল-শামস ও নুর আল-দিন আল-জিঙ্কির সৈন্যরা রয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই জোটের গোড়াপত্তন হয়।

সিরীয় সংকটের সূচনা
২০১১ সালে ‘কথিত’ আরব বসন্তের অভিঘাত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের গদিতেও লাগে। পিতা-পুত্র মিলে প্রায় পাঁচ দশক ধরে দেশটির শাসনে। আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আছেন বাশার আল-আসাদ।

আরব বসন্তের জোয়ারে প্রথমে সিরিয়ার বিরোধী দলগুলো একনায়কতান্ত্রিকতার পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে। কিন্তু আসাদ বিক্ষোভ দমন করেন সেনাবাহিনী নামিয়ে দেন। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই নিহত হন। পরবর্তী দিনগুলোয় সংকট ক্রমে গভীর হয় এবং সঙ্গে যোগ হয় নানা সমীকরণ, বাড়তে থাকে হতাহত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা।। জাতিসংঘের হিসাব মতে, এ পর্যন্ত সিরিয়ায় প্রাণহানির ঘটনা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বেসামরিক লোক। বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ বেসামরিক মানুষ। জাতিসংঘ সিরীয় সংকটকে দেখছে একুশ শতকের সবচেয়ে জঘন্য ও নিষ্ঠুর সমস্যা হিসেবে।


পক্ষ-বিপক্ষ সংকটে সংকট

সিরীয় সংকট গভীর থেকে গভীরতর গাড্ডায় পড়ে যখন নিজস্ব সমীকরণে বেশ কয়েকটি দেশ এবং গোষ্ঠী আসাদ ও আসাদবিরোধীদের সহযোগিতায় প্রকাশ্য মাঠে নামে, তখন আসাদের পক্ষে অবস্থান নেয় রাশিয়া, ইরান ও লেবাননে যুদ্ধরত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সৌদি আরব ও জার্মানি।

সিরিয়ার এই সংকট শুধু দুটো পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তারা চায় শিয়াপন্থী আসাদকে হটাতে। আমেরিকাও চায় আসাদের পতন। এদিক দিয়ে আইএস ও আমেরিকার মনোভাব এক হলেও তারা আদর্শগতভাবে বিরোধী। এ কারণে আমেরিকা একই সঙ্গে আসাদবিরোধীদের আবার আইএস হটাতেও অস্ত্র ও অর্থ ব্যবহার করতে থাকে।

এই সমীকরণকে আরও জটিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, সৌদি আরব ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের মদদপুষ্ট আসাদবিরোধী ‘জাতীয় পরিষদ’। আদর্শগত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে আল-কায়েদা ও আল নুসরাকে সেখানে স্থান পায়নি, যা আরেকটি সংকট তৈরি করেছে। অন্যদিকে, স্বাধীন আবাসভূমির দাবিতে সিরিয়ার যুদ্ধের মধ্যে ময়দানে নামে কুর্দি মিলিশিয়ারা। তাদের দমন করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তৎপর হয় তুর্কি বাহিনী।


ইদলিবে কি সমাপ্ত হচ্ছে সিরিয়া সংকট?
সিরীয় সরকার ও তার মিত্র দেশগুলো হয়তো মনে করছে, ইদলিবে বিদ্রোহী ও জিহাদিদের হটিয়ে দিতে পারলে সাত বছরের এই গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু চলতি শতকের ইতিহাস তা নাকচ করে দিচ্ছে। ইরাক ও আফগানিস্তানের উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। আপাতদৃষ্টিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়লেও তারা তাদের চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কা থাকবে। এরপর রয়েছে বিধ্বস্ত সিরিয়াকে পুনর্গঠনের কাজ রয়েছে। এটা বেশ শক্ত কাজ। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ না থাকলে আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীগুলো আসাদ সরকারের জন্য কতটা কী করবে বলা কঠিন। এসব বড় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নিয়ন্ত্রণের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলো। আর মাঠে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে আছে কুর্দি ও তুর্কি ছাড়াও আরও কয়েকটি বাহিনী। এ কারণে ইদলিবে সিরীয় সংকটের ইতি টানার যে সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, একমাত্র সময়ই বলতে পারে তা শেষ পর্যন্ত ঘটতে যাচ্ছে কি না।