একসময়ের সহকর্মীই পুতিনের জাতশত্রু?

২০০০ সালে প্রথমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই কথিত বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহীদের পাকড়াও করতে নেমে পড়েন ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স
২০০০ সালে প্রথমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই কথিত বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহীদের পাকড়াও করতে নেমে পড়েন ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

দুজনের বয়স প্রায় সমান। একজন এখন বিশ্বের নতুন মেরুকরণে মোড়লের ভূমিকায় আছেন। আরেকজন কিছুদিন আগেও ছিলেন হাসপাতালের বিছানায়, এখন কোথায় কেউ জানে না। দুজনেই একসময় একই পথের পথিক ছিলেন, ছিলেন সহকর্মী। কিন্তু ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের কালে দুজনের পথ বেঁকে যায় দুই দিকে। এরপরই শুরু শত্রুতার গল্প।

গল্পটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে নিয়ে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থায় দুজনেই গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর পুঁজিবাদী-সমাজতান্ত্রিক রেষারেষির অবসান হয়। সারা বিশ্বে একতরফা প্রভাব বিস্তার শুরু করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি। সেই অর্থের জোরের কাছে অনেক সমাজতন্ত্রীই নিজের আদর্শিক পরিচয় বিসর্জন দিয়েছিলেন। সোভিয়েত ঘরানার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আদর্শে বিশ্বাস ধরে রাখা তখন বেজায় কঠিন। হাওয়া বদলের সেই ঝড়ে পড়েছিলেন স্ক্রিপালও। টলে গিয়েছিল তাঁর সততার ভিত, বনে যান ডবল এজেন্ট।

মেয়ে ইউলিয়ার সঙ্গে সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল। যুক্তরাজ্য পুলিশের দাবি, রাসায়নিক নার্ভ এজেন্ট নোভিচক ব্যবহার করে তাঁদের হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
মেয়ে ইউলিয়ার সঙ্গে সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল। যুক্তরাজ্য পুলিশের দাবি, রাসায়নিক নার্ভ এজেন্ট নোভিচক ব্যবহার করে তাঁদের হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু গত ৪ মার্চের আগে স্ক্রিপাল কোনো পরিচিত নাম ছিল না। দিনটি ছিল রোববার। ইংল্যান্ডের সলসবুরি সিটি সেন্টারের একটি বেঞ্চে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়াকে। যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী এই রুশ নাগরিক ও তাঁর মেয়েকে রাসায়নিক নার্ভ এজেন্ট নোভিচক ব্যবহার করে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল বলে যুক্তরাজ্য পুলিশের দাবি। হাসপাতালে কিছুদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর সেরে ওঠা সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়েকে নিরাপত্তার স্বার্থে নেওয়া হয় গোপন ডেরায়।

এরপর পরই যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হয়ে যায় তুমুল বাদানুবাদ। যুক্তরাজ্যের দাবি, স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। সন্দেহভাজন দুই রুশ হামলাকারী তথা গুপ্তচরের বৃত্তান্তও প্রকাশ করা হয়েছে। এমন গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় ক্রেমলিন। পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ার এই খেলা এখনো শেষ হয়নি। সম্প্রতি পুতিন বলেই দিয়েছেন, সন্দেহভাজন ঘাতকেরা অপরাধী নন। তাঁরা বেসামরিক নিরপরাধ ব্যক্তি। এর বিপরীতে যুক্তরাজ্যের বক্তব্য, ওই দুই রুশ নাগরিককে অপরাধী প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্যউপাত্ত তাদের হাতে আছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এবারই যুক্তরাজ্য-রাশিয়ার সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এ ঘটনায় দুই দেশই কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা ঘটিয়েছে। বিতর্কের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি। পুতিনের ‘বেসামরিক’ তত্ত্বের এক দিন পরই সন্দেহভাজন দুই রুশ হামলাকারীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে এই সংবাদমাধ্যম। সেখানে যুক্তরাজ্যের চোখে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, তাঁরা নিতান্তই পর্যটক! হত্যাচেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নাকচ করে দিয়েছেন তাঁরা। এনেছেন সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার বিষয়টিও।

কিন্তু স্ক্রিপাল কেন পুতিনের দুই চোখের বিষ? এর একটি নাতিদীর্ঘ ইতিহাস আছে। চলুন তবে, কিছুটা পেছন ফিরে তাকানো যাক।

ইংল্যান্ডের সলসবুরি সিটি সেন্টারের এই বেঞ্চে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়াকে। ঘটনার পর বেঞ্চটি ঘিরে রাখা হয়। ছবি: রয়টার্স
ইংল্যান্ডের সলসবুরি সিটি সেন্টারের এই বেঞ্চে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়াকে। ঘটনার পর বেঞ্চটি ঘিরে রাখা হয়। ছবি: রয়টার্স


শুরুর গল্প
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন থেকে সৃষ্ট রাশিয়া তখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। স্তালিনের দেশ তখন অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর, সামরিকভাবে দুর্বল। মাসের পর মাস মাইনে পাচ্ছেন না শ্রমিক, সৈন্য ও চিকিৎসকেরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, বেতন না পেয়ে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা!

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিক এই সময়েই স্পেন থেকে রাশিয়ায় ফেরেন সের্গেই স্ক্রিপাল। মাদ্রিদে রুশ মিলিটারি অ্যাটাশের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি। বলে রাখা ভালো, স্পেনে গুপ্তচর হিসেবেই ছিলেন স্ক্রিপাল। দেশের সবাই যখন রুটিরুজির চিন্তায় ব্যাকুল, তখন স্ক্রিপালকে পাওয়া যায় খোশমেজাজে।

মস্কোতে সের্গেই স্ক্রিপালের একসময়ের সহকর্মী ওলেগ বি. ইভানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রেস্তোরাঁয় খেতে বসলে আশপাশে বসে থাকা সব পরিচিতজনের খাবারের বিল দিতে চাইতেন সের্গেই। আর এটিই ছিল সবচেয়ে আশ্চর্যের। কারণ, সবার যখন পকেট ফাঁকা, তখন কিসের জোরে এত মজায় আছেন স্ক্রিপাল? উত্তর, অর্থ।

যুক্তরাজ্যের দাবি, স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। সন্দেহভাজন দুই রুশ হামলাকারী তথা গুপ্তচরের ছবি ও বিস্তারিত তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্যের দাবি, স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। সন্দেহভাজন দুই রুশ হামলাকারী তথা গুপ্তচরের ছবি ও বিস্তারিত তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে ওই সময়কার সব আদর্শ বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। সোভিয়েত নিয়মকানুনের ধার ধারছিল না কেউ। সবার ধ্যানজ্ঞান তখন একটিই—নিজের রোগা মানিব্যাগ ঢাউস করতে হবে। সেই স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন স্ক্রিপালও। বন্ধু-বান্ধবেরা বলছেন, সের্গেই স্ক্রিপাল ছিলেন আগাগোড়া বস্তুবাদী। অর্থ রোজগারই ছিল তাঁর মূল নেশা।

এই নেশাতেই ফেঁসে যান রাশিয়ার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তা স্ক্রিপাল। ২০০৬ সালে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। অভিযোগ ছিল, ১৯৯৬ সাল থেকে স্পেন ও যুক্তরাজ্যের কাছে রাশিয়ার গোপন গোয়েন্দা তথ্য বিক্রি করেছেন স্ক্রিপাল। বিনিময়ে পেয়েছিলেন এক লাখ ডলার। বিচার শেষে ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি।

পরিচিতজনদের মতে, দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এই রুশ গুপ্তচর। কিন্তু তখন রাশিয়ায় সোভিয়েত আমলের সব কাঠামোই ভেঙে পড়েছিল। সবাই ছুটছিল অর্থের পেছনে। পুঁজির নেশায় মজে যাওয়া একটি দেশ, যেখানে সদ্যই সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হয়েছে, সেখানে কে কাকে সততার সঠিক সংজ্ঞা দেবে!

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থায় গুপ্তচর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সের্গেই স্ক্রিপাল। ছবিটি বিবিসির সৌজন্যে
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থায় গুপ্তচর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সের্গেই স্ক্রিপাল। ছবিটি বিবিসির সৌজন্যে


ভাঙনের দিনগুলোতে পুতিন
১৯৯০ সালে রাশিয়ায় ফিরে এসেছিলেন তৎকালীন কেজিবি কর্মকর্তা ভ্লাদিমির পুতিন। পূর্ব জার্মানিতে পদায়ন ছিল তাঁর। চোখের সামনে প্রবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধসে পড়তে দেখেছেন পুতিন। দেশে ফেরার পথে তাঁর সম্বল বলতে ছিল ২০ বছরের পুরোনো একটি ওয়াশিং মেশিন। বকেয়া ছিল তিন মাসের মাইনে। পকেট খালি, তার ওপর নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। পুতিনসহ অনেক রুশ গুপ্তচরের জন্য জীবন তখন বড়ই কঠিন।

পুতিনের জীবনীকার স্টিভেন লি মায়ারস বলেন, সোভিয়েত ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক গোয়েন্দা তথ্য বেহাত হয়ে গিয়েছিল। কিছু রুশ গুপ্তচর এ কাজে জড়িত ছিলেন। এ কাজকে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিনের চোখে এই বিশ্বাসঘাতকেরা ‘পশু’, এঁরা ক্ষমার অযোগ্য।

এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেছিলেন, ‘বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম খুব খারাপ হয়। নিয়ম হলো—হয় অতিরিক্ত মদ্যপানে তাঁদের মৃত্যু হবে, নয়তো মাদক ব্যবহারে।’

দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরদের দুই চোখে দেখতে পারেন না বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিনের চোখে এসব বিশ্বাসঘাতক ‘পশু’, এঁরা ক্ষমার অযোগ্য। ছবি: রয়টার্স
দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরদের দুই চোখে দেখতে পারেন না বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিনের চোখে এসব বিশ্বাসঘাতক ‘পশু’, এঁরা ক্ষমার অযোগ্য। ছবি: রয়টার্স

২০০০ সালে প্রথমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই কথিত বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহীদের পাকড়াও করতে নেমে পড়েন ভ্লাদিমির পুতিন। ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার প্রথম বছরেই গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অনেককে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করেন তিনি। নিন্দুকেরা বলেন, প্রতিশোধ নিতেই ওই ধরপাকড় চালিয়েছিলেন পুতিন।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই রুশ নিরাপত্তা বাহিনী এক ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সম্পর্কে তথ্য পায়। তাঁর কাজ ছিল রুশ গুপ্তচরদের ডবল এজেন্ট বানানো। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তির খপ্পরেই পড়েছিলেন সের্গেই স্ক্রিপাল। আর এই সময় থেকেই সাবেক সহকর্মী পুতিনের কুনজরে পড়েন স্ক্রিপাল। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে শত্রুতা, শুরু হয় প্রতিশোধের পালা।

আজ এ পর্যন্তই থাক। দুই সাবেক গুপ্তচরের ঘৃণা ও প্রতিশোধের গল্প হবে কাল সকালে। সেখানে দেখা যাবে একজন কীভাবে উঠছেন ক্ষমতার শীর্ষে, উল্টো দিকে তাঁরই সাবেক সহকর্মী তলিয়ে যাচ্ছেন দুরবস্থার অতলে!